Advertisment

Premium: কলকাতার বড়দিনের ঐতিহ্য, ৯৩ বছর ধরে তিলোত্তমায় কেকের কাব্য লিখছে সালদানা

পুরনো কলকাতা এবং কেকের ইতিহাস এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
saldanha bakery kolkata christmas cakes , সালদানা বেকারি কলকাতা বড়দিনের কেক

সামনেই বড়দিন, কেক তৈরির ব্যস্ততা সালদানা বেকারিতে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

শীত কাতুরে বাঙালির চিরকালই শীত নিয়ে রোমান্টিসিজম রয়েছে। শীতের সকালে চাদর মুড়ি দিয়ে এই বাংলার কবি সাহিত্যিকরা কত গল্প উপন্যাস লিখেছে তার হিসেব কষতে গেলে লম্বা ফর্দ তৈরি হয়ে যাবে। এবছর শীত আসতে একটু দেরি করেছে। তাতে অনেকেরই মন খারাপ ছিল। তারউপর নিম্নচাপের জেরে দু'একদিনের বৃষ্টি। তবে বৃষ্টি শেষে এখন হালকা হাওয়াই জানান দিয়ে যাচ্ছে রোমান্টিকতার। এ শহরে শীত আসছে। এই শীত বরফের দেশের মতো সাদা নয়। উত্তুরে হাওয়া সাদা তুলোর মতন বরফ উড়িয়ে আনে না। কলকাতার শীত মানে বাজারে রং বেরঙের সবজি। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ। কুয়াশা মোড়া সকাল। মিঠে রোদ্দুরে গা এলিয়ে বসে থাকা। নিউমার্কেট থেকে হাতিবাগানে শীত পোশাকের ভিড়। ধোঁয়াটে সন্ধ্যে। শীতকাল এলেই ধুলো মাখা ধূসর কলকাতা যেন চির সবুজ হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ শহর যেন হয়ে ওঠে একুশ বছরের ছোকরা। বয়স কমতে থাকে। সেজে ওঠে পার্ক স্ট্রিট। দোকানে দোকানে দাঁড়িয়ে পড়ে ক্রিসমাস ট্রি। নাকে ভেসে আসে কেক-পেস্ট্রির গন্ধ। এই শহরে ক্যাফে কিংবা বাহারি কেকের ঠেক এমনিতে কম নেই। আর, এখন তো অনলাইনের যুগ! ক্রিসমাসের আগে স্ক্রিন টাচেই বাড়িতে পৌঁছে যায় কেক-পেস্ট্রিরা। এই সহজলভ্যতার যুগে কলকাতা শহরে এখনও এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে লুকিয়ে আছে কেকের স্বর্গরাজ্যে। পুরনো কলকাতা এবং কেকের ইতিহাস এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এরকমই একটি জায়গা সালদানা। ৯৩ বছরের পুরনো একটি গোয়ানিজ বেকারি।

Advertisment

এমনিতেই এই শহরটার বুকে অনেক ইতিহাস লুকিয়ে। তা বলে সালদানাকে খুঁজতে ইতিহাসের পাতা ওল্টানোর প্রয়োজন পড়ে না। কলকাতার দু'একজন প্রবীণ নাগরিককে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায় সালদানার অতীত। রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের ট্রাম লাইন ধরে তালতলা হয়ে এগোলে, রাস্তা চলে গিয়েছে আবদুর রাহমান স্ট্রিটের দিকে। রিপন স্ট্রিট থেকে আবদুর রাহমান স্ট্রিট হেঁটে গেলে সময় লাগে ১৫ মিনিটের কাছাকাছি। এখানেই সরু গলির মাথায় বেকারি। বাড়ির সামনে হলুদ রঙের দেওয়ালে লাল অক্ষরে লেখা নাম। সামনেই দাঁড়ালেই গন্ধেই জানান দেবে এখানকার কেক কেন সকলের থেকে আলাদা!

publive-image
বাড়ির সামনে হলুদ রঙের দেওয়ালে লাল অক্ষরে লেখা নাম সালদানা। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

গেটের সামনে বসে থাকা সিকিউরিটি গার্ডের দেখানো পথ ধরে দোতলায় ওঠার সময়ই ডানদিকের ঘরেই চোখে পড়বে জনা দশেক মানুষ। এক নাগাড়ে কাজ করছে। হাতে হাত মিলিয়ে চলছে বেকিং। গামলায় করে সাজানো কেক তৈরির সরঞ্জাম। সামনেই বড়দিন, তারই অর্ডার আসছে মুহুর্মুহু। ব্যস্ততাও তুঙ্গে। তাই সালদানা বেকারির মানুষজনের কাজের অন্ত নেই। কাঠ কয়লার আঁচে চুল্লিতে একের পর কেক বেক করা হচ্ছে। কেকের গন্ধে মন ভালো হয়ে যায়।

প্যাটিস পেস্ট্রির যুগে বেকারি কেকের চাহিদা বেশ কমেছে। কিন্তু তার অস্তিত্ব যে আজও হারাতে দেয়নি সালদানা বেকারির লোকজনদের দেখে বেশ ভালোই বোঝা যায়। গোয়া থেকে কলকাতায় এসে কেক-পেস্ট্রির স্বাদে বুঁদ করা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতারও আগে। সময়টা ১৯৩০। উবেলিনী সালদানা এবং তাঁর স্বামী ইগনেসিয়াস সালদানা গোয়া থেকে কলকাতায় এসে এই বেকারিটি শুরু করেন। অতীত থেকে বর্তমান সালদানার ঐতিহ্যকে শাসন করে যাচ্ছে তিন প্রজন্মের তিন কন্যা। এখন বেকারির সম্পূর্ণ দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ডেব্রা অ্যালেকজেন্ড্রা এবং তার মেয়ে আলিসা অ্যালেকজেন্ড্রা। ডেব্রা তৃতীয় প্রজন্ম। প্রথম থেকে আজও ভরপুর বিশ্বাস রয়েছে কলকাতাবাসীর এই বেকারির ওপর।

publive-image
ডেব্রা অ্যালেকজেন্ড্রা এবং তার মেয়ে আলিসা অ্যালেকজেন্ড্রা বর্তমানে সালদানার সমস্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

ডেব্রায় বলছিলেন এই বেকারির ইতিহাস, "আগে ২০-৩০ জন মাথায় ঝুড়ি নিয়ে বের হতো বেকারি কেক বিক্রি করতে। এছাড়াও ঝুড়িতে থাকতো সানলাইট বিস্কুট, লেমন টার্ট। ছোটবেলায় আমাদের এখানে ফেরিওয়ালাদের ভিড় লেগে থাকতে দেখেছি। কিন্তু এখন আর এসব নেই। আমাদের থেকে কেক কিনতে এখন আগে থেকে অর্ডার করতে হয়। অর্ডার ছাড়া আমরা বানায় না। টাটকা জিনিস খাওয়ানোর চেষ্টা করি সবসময়। আমাদের চিকেন প্যাটিস, চকোলেট পেস্ট্রি, কোকোনাট মাকারুন, ফ্রেঞ্চ ম্যাকারুন, ক্রিম রোল, চিকেন প্যাটিস, এনভেলপ, চিজ স্ট্যস, স্যান্ডুইচ, গার্লিক ব্রেড এসব পদের সম্ভারও রয়েছে।" ডেব্রার মেয়ে আলিসা বিলেত থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছে। অলিসার পরিকল্পনাতেই সালাদানার মেন্যুতে সংযোজিত হয়েছে চিকেন বাকেট, চিজ পাফের মতন খাবার। আশ্চর্য সস্তা দামে গ্রাহকেরা বিভিন্ন ধরণের কেক এখানে সহজে পেয়ে যান। ২৫ এবং ৩১শে ডিসেম্বর এখানের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতোই। এসময়টাতেই অর্ডার ছাড়া কেক মেলে। ক্রিস মাসের আগে ফ্রুট কেক, ওয়ালনাট, চকোলেট কেক এসবের জন্যে লম্বা লাইন পরে যায় সালদানাতে। স্বাদ এবং কোয়্যালিটির ব্যাপারে সব সময়ই সজাগ মিস ডেব্রা। এই কারণেই গোয়ান এই পরিবারটি আজও বজায় রেখে চলেছে কলকাতায় হাতে তৈরি কেকের ট্র্যাডিশন।

publive-image
কেক তৈরি করার সব সময় সজাগ দৃষ্টি থাকে মিস ডেব্রা'র। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

যেকোনো উৎসবে সালদানার কেক লাজবাব। জন্মদিন, বড়দিন তো বটেই। খ্রিস্টান বিয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ কেক। সালদানার তাতে দেশজুড়ে সুনাম। বাইরের অনেক রাজ্যে থেকেও মানুষজন এসে সালদানার কেক নিয়ে যান। বেকারির কর্মচারী থেকে খরিদ্দার, সকলের কাছেই ডেব্রা আন্টি। একের পর এক খরিদ্দার আসছে আর যাচ্ছে ডেব্রা আন্টির মুখের হাসি লেগেই আছে। সালদানার আবহের সঙ্গেই মিশে আছে আন্তরিক ব্যবহার, সদাহাস্য মুখ। এটায় এখানকার ইউএসপি। না আছে চকচকে মোড়ক, না তুমুল বিজ্ঞাপন! তা সত্ত্বেও, হাল ফ্যাশনের যে কোনও ঝঁ চকচকে কেক-পেস্ট্রি শপকে সহজে টেক্কা দেবে সালদানা।

publive-image
খরিদ্দারদের জন্যে সালদানার প্যাকেটে করা হচ্ছে কেক প্যাকেজিং। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

অফিস ফেরত অনেকেই আজও এখান থেকে বাড়ির জন্যে কেক নিয়ে যান। আর সামনে যীশুর জন্মদিন। কেক ছাড়া তো অসম্পূর্ণ। প্রতি বছর শীতের সময়টায় বাঙালির জিভে এক টুকরো সালদানহার ওয়ালনাট কেক বা কোকোনাট ম্যাক্রুন বা চিজ পাফ না পড়লে যেন আলো ঝলমলে আনন্দের অনেকটাই বাকি থেকে যায়।

kolkata New Year Celebration saldanha bakery Christmas Eve
Advertisment