'প্যালেস্টাইন সেই অর্থে আরবদের। যে অর্থে ইংল্যান্ড ইংরেজদের বা ফ্রান্স ফরাসিদের।'- মহাত্মা গান্ধী ১৯৩৮ সালের ২৬ নভেম্বর, হরিজন পত্রিকায় এমনটাই লিখেছিলেন। গান্ধীর প্রবন্ধ- 'ইহুদি' ছিল তীব্র বিতর্কের বিষয়। বছরের পর বছর, কেউ এই প্রবন্ধকে নির্বোধতার প্রমাণ বলে দাবি করেছেন। অনেকে আবার অহিংসার প্রতি গান্ধীর গভীর প্রতিশ্রুতির প্রমাণ হিসেবেও দেখেছেন। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের ইতিহাসের সর্বশেষ রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্যে গান্ধীর সেই ভাবনাকে কার্যত সিলমোহর দিয়ে অনেকেই স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন।
গান্ধী-ইহুদিদের সম্পর্ক
মহাত্মা গান্ধী রীতিমতো স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে ইহুদিদের প্রতি তাঁর গভীর সহানুভূতি রয়েছে। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিরা তাঁদের ধর্মের জন্য অন্যায়ভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। গান্ধী এই ব্যাপারে তাঁর ‘দ্য ইহুদি’ বইতে লিখেছেন, 'আমার সহানুভূতি সব ইহুদিদের প্রতি। তাঁরা খ্রিস্টান ধর্মের অস্পৃশ্য। তাঁদের প্রতি খ্রিস্টানদের আচরণ, ইহুদিদের প্রতি হিন্দুদের আচরণ সমান্তরাল বা খুব কাছাকাছি। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁদের প্রতি অমানবিক আচরণের ন্যায্যতাকে ধর্মীয় অনুমোদন হিসেবে দেখানো হয়েছে।'
জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চেয়েছিলেন গান্ধী
তিনি আরও লিখেছেন তবে, 'ইহুদিদের ওপর জার্মান নিপীড়নের ইতিহাসের কোনও সমান্তরাল নেই বলেই মনে হয়।' সে সময়ে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে) অ্যাডলফ হিটলারকে শান্ত করার জন্য ব্রিটেনের নীতি নিয়েও গান্ধী উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে মানবতার কারণে এবং ইহুদি জনগণের নিপীড়ন প্রতিরোধ করার জন্য জার্মানির সঙ্গে একটি যুদ্ধ, 'সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত' হবে। গান্ধী লিখেছেন, 'যদি কখনও মানবতার নামে এবং তার জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ হতে পারে, একটি সমগ্র জাতির প্রতি নির্মম-নিপীড়ন প্রতিরোধ করার জন্য, জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত হবে।'
ইহুদি রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন না
তবুও, তিনি প্যালেস্তাইনে কোনও ইহুদি রাষ্ট্রের উৎপত্তিকে সমর্থন জানাননি। আরবদের ওপর ইহুদিদের চাপিয়ে দেওয়া ভুল এবং অমানবিক ব্যাপার হবে। আরবদের গর্ব হ্রাস করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হবে বলেই মনে করতেন। রাষ্ট্র না-হলেও প্যালেস্তাইনকে যাতে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ইহুদিরা থাকতে পারেন, তেমনটাই চেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি মূলত দুটি কারণে প্যালেস্তাইনে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র গঠনের বিরোধী ছিলেন। তার একটি হল, প্যালেস্তাইন ইতিমধ্যেই আরবদের আবাস ছিল। আর, ব্রিটেন সেখানে ইহুদিদের বসতি গড়তে সাহায্য করেছিল। সেই বসতি গঠনের প্রচেষ্টা ছিল সহিংস। সেটাই ছিল গান্ধীজির বিরোধিতার কারণ।
গান্ধীর প্যালেস্তাইন ধারণা
তিনি লিখেছিলেন, 'একটি ধর্মীয় কাজ (প্যালেস্তাইনে ইহুদিদের ফিরে আসা) বেয়নেট বা বোমার সাহায্যে করা যাবে না।' গান্ধী মনে করেছিলেন যে ইহুদিরা প্যালেস্তাইনে বসতি স্থাপন করতে পারে শুধুমাত্র 'আরবদের সদিচ্ছায়' এবং এজন্য তাঁদের 'ব্রিটিশ বেয়নেট ত্যাগ' করতে হবে। দ্বিতীয়ত, গান্ধী অনুভব করেছিলেন যে একটি ইহুদি স্বদেশের ধারণা বিশ্বের অন্যত্র বৃহত্তর অধিকারের জন্য ইহুদিদের লড়াইয়ের মৌলিক বিরোধী ছিল। গান্ধী লিখেছেন, 'যদি ইহুদিদের প্যালেস্তাইন ছাড়া আর কোনও বাড়ি না থাকে, তাহলে তাঁরা কি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল যেখানে তাঁরা বসতি স্থাপন করেছেন, সেসব অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়ার ধারণাটি উপভোগ করবেন?' শুধু তাই নয়, গান্ধী আরও লিখেছেন যে, একটি জাতীয় বাড়ির জন্য ইহুদিদের দাবি, 'জার্মানি থেকে ইহুদিদের বহিষ্কারকে রঙিন ন্যায্যতা' দিয়েছে।
ভারতের বিদেশনীতিতে প্রভাব
ইজরায়েল সম্পর্কে গান্ধীর অবস্থান ভারতের বিদেশনীতিকেও প্রভাবিত করেছিল। মহাত্মার অবস্থান অবশ্য কোনওভাবেই বিতর্কহীন ছিল না। আরব বিশ্বের নেতারা এবং এর বাইরেও সাম্রাজ্য বিরোধীরা, ব্রিটেনের প্যালেস্তিনীয়রা, ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণায় আতঙ্কিত হয়েছিল। কারণ, ওই ঘোষণায় ব্রিটেন ইহুদিদেরকে একটি স্বদেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রয়াত ব্রিটিশ লেখক আর্থার কোয়েস্টলার, যিনি নিজে একজন ইহুদি, এই ঘোষণা সম্পর্কে লিখেছেন, 'একটি জাতি দ্বিতীয় জাতিকে তৃতীয় এক দেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।'
আরও পড়ুন- অবস্থান বদল! দীর্ঘদিন প্যালেস্তাইনের পাশে থাকা ভারত কীভাবে ঢলে গেল ইজরায়েলের দিকে?
ইজরায়েল-ভারত সম্পর্কে প্রভাব
গান্ধীর মতামত, এবং তাঁর নিজের সাম্রাজ্য বিরোধিতা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং কয়েক দশক ধরে নতুন দেশের বিদেশনীতি গঠনে ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিবিদ চিন্ময় ঘরেখান ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, 'বিভিন্নভাবে, নেহেরু এই দৃষ্টিভঙ্গি মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন।' ভারত রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব ১৮১-এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে যা ইহুদি এবং আরবদের মধ্যে প্যালেস্তাইনকে বিভক্ত করেছিল। যদিও ভারত ১৯৫০ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাওয়ের অধীনে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ভারত এবং ইজরায়েলের মধ্যে কোনও আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি।