গত শতাব্দীর কুড়ির দশকে ঠাকুরবাড়ি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধারণ মানুষের কাছে একটা তীর্থস্থানের মতোই হয়ে উঠেছিল। এমন এক তীর্থস্থান, যাকে বেশিরভাগই দূর থেকে প্রণাম করে চলে যেতেন। সমীহ ছিল, কিন্তু সাধারণের সঙ্গে রবি ঠাকুরের গানের আত্মার যোগাযোগটা তখনও পাকাপোক্ত হয়নি। সেই যোগাযোগটা পাকা করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। সিনেমায় রবীন্দ্রগান প্রথম তিনি ও রাইচাঁদ বড়াল যুগ্মভাবে শুরু করেন। হিন্দি সিনেমায় তিনিই প্রথম এনেছিলেন রবির সুর। তাই ২৫ বৈশাখ দিকে দিকে যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত বেজে উঠছে, তখন সেই মানুষটির কথা একবার না মনে করলেই নয়।
নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে পঙ্কজ মল্লিক। একান্নবর্তী পরিবার চালানোর বোঝা ঘাড়ে নিয়ে একরোখা হয়েছিলেন যে শুধুই গান গাইবেন ও সঙ্গীতসাধনা করবেন। তা থেকে যা রোজগার হবে তাই। রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতায় মগ্ন থাকতেন কলেজ পড়ুয়া পঙ্কজ। সেই মগ্নতা থেকেই একবার দুম করে একটা কাণ্ড ঘটালেন। সুর দিয়ে ফেললেন 'শেষ খেয়া' কবিতায়। সে না হয় কেউ করতেই পারেন জনান্তিকে। কিন্তু গানটি তিনি প্রকাশ্যে গাইতে শুরু করলেন। জোড়াসাঁকোয় খবর গেল।
আরও পড়ুন: নির্বাক চলচ্চিত্রে রবি ঠাকুর
প্রথমবার তাঁকে ডেকেছিলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আসলে সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের কোনও গান প্রকাশিত স্বরলিপি ছাড়া গাওয়া যেত না। আর রবির কবিতায় যদি কেউ সুর দেওয়ার দুঃসাহস করেও ফেলতেন, তবে তাঁকে শুনিয়ে অনুমতি নিতে হত গানটি প্রকাশ্যে গাওয়ার আগে। পঙ্কজ মল্লিক ছিলেন গানপাগল মানুষ। তখনও নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে কাজ শুরু করেননি, দুনিয়াদারি অতটা বুঝতেন না। প্রথম বার জোড়াসাঁকোয় গিয়ে রথীন্দ্রনাথের হালকা বকুনি শুনে, 'ওটা রবি ঠাকুরেরই সুর, বন্ধুর কাছে স্বরলিপি আছে, পরে দেখাব' গোছের একটা অজুহাত দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলেন, এমনটাই জানা যায় দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখায়।
কিন্তু মিথ্যা কতক্ষণ চাপা থাকে? পরের বার পঙ্কজ মল্লিক গিয়ে পড়লেন সোজা বাঘের মুখে। আর সেটাই বোধহয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। কবির ঘরে একটা বিরাট হ্যামিল্টন অর্গান থাকত। চোখের ইশারায় সেই অর্গানটি দেখিয়েছিলেন কবি। তটস্থ পঙ্কজ মল্লিক যাবতীয় সাহস সঞ্চয় করে গেয়েছিলেন 'আমায় নিয়ে যাবি কে রে, দিনশেষের শেষ খেয়ায়, ওরে আয়, দিনের শেষে...'। শোনা যায়, গানটি শুনে রবীন্দ্রনাথ যেন ধ্যানস্থ হয়ে চুপ করে বসেছিলেন।
দ্বিতীয়বার কবির সামনে যখন আসেন ওই গানটি নিয়ে সেটা তিরিশের দশক। ততদিনে পঙ্কজ মল্লিক বেশ প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র জগতে। বেতারশিল্পীও বটে। প্রমথেশ বড়ুয়া তাঁর ছবিতে পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত 'শেষ খেয়া' গানটি রাখতে চান কিন্তু সিনেমায় এই গান ব্যবহার করতে গেলে কবির অনুমতি চাই। কবি অনুমতি দিলেন শুধু নয়, সুরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, একটি পঙক্তি-তে পরিবর্তনও করলেন। পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া এই গানটি বাঙালি যেমন কখনও ভুলতে পারেনি, তেমনই বাঙালি ভুলতে পারবে না কখনও কে এল সায়গলের গলায় 'আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান'।
আরও পড়ুন: টেলিপর্দায় আবার ‘রবি ঠাকুরের গল্প’, ২৫ বৈশাখ থেকে
সায়গল-ই প্রথম অবাঙালি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। সেই তিরিশ-চল্লিশের দশকে একজন অবাঙালির গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বাংলার মানুষ বিভোর হয়েছিলেন। বন্ধু কুন্দনলালকে নিজেই রবীন্দ্রগান শিখিয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত তো আর পাঁচটা গানের মতো নয় যে সুর তুলে দিলেই হল। এই গান ঠিকঠাক গাইতে হলে অন্তর থেকে গাইতে হয়। তাই যিনি শেখাচ্ছেন তাঁকে গানের ভাবটা যেমন বোঝাতে হয় ছাত্রকে। তেমনই সেই ভাবকে সুরের মাধ্যমে প্রকাশ করতে কণ্ঠস্বরকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেটাও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার অঙ্গ। সেই কারণেই এত জনপ্রিয় হয়েছিল বেতারে 'সঙ্গীত শিক্ষার আসর' যেখানে একটা সময় পর্যন্ত নিয়মিত অন্যান্য গানের পাশাপাশি বাঙালিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শিখিয়েছিলেন তিনি।
তিরিশের দশক থেকেই হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে বার বার ডাক এসেছিল। তিনিই প্রথম হিন্দি ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেন। সামগ্রিক ভাবে সিনেমায় যদি ধরা যায়, তবে এই ক্রেডিট যুগ্মভাবে দিতে হয় পঙ্কজ মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়ালকে। দুজনে একসঙ্গে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ব্যবহার করেছিলেন দুটি নির্বাক ছবির আবহে-- 'চোরকাঁটা' ও 'চাষার মেয়ে'। এর পরে আসে প্লেব্যাকের যুগ। 'মুক্তি' ছবিতে একগুচ্ছ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্লেব্যাক করা হয়। এই ছবি থেকেই কিন্তু বাংলা ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহুল ব্যবহার শুরু হয়ে। 'মুক্তি' ছবিতেই ছিল কানন দেবী-র গাওয়া 'আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে' এবং 'তার বিদায়বেলার মালাখানি'। সবটাই পঙ্কজ মল্লিকের তত্ত্বাবধানে।
আরও পড়ুন: ‘সংস্কৃতিতে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, তাই রবীন্দ্রনাথ সবার হলেন না’
হিন্দি ছবিতে যখন সঙ্গীত পরিচালনার প্রসঙ্গ আসে, তখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার তাঁর কাছে ছিল অপরিহার্য। ১৯৪১ সালের 'ডক্টর' ছবির গান, 'চলে পবন কি চাল'-এ প্রথম রবীন্দ্রনাথের সুর ব্যবহার করেন পঙ্কজ মল্লিক, এমনটাই জানা যায় অভিজিৎ রায়ের একটি রচনায়। তবে হিন্দি ছবিতে রবি ঠাকুরের গানের বহুল ব্যবহার কিন্তু পঙ্কজ মল্লিকের পাশাপাশি শচীন দেব বর্মনও শুরু করেছিলেন পঞ্চাশের দশক থেকে। ১৯৫০ সালে 'অফসর' ছবির জন্য শচীন দেব বর্মন কম্পোজ করেছিলেন 'নই দিওয়ানে, এক নহি মানে' ('সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে' অনুপ্রাণিত)।
কিন্তু যদি রবীন্দ্রগানের পূর্ণাঙ্গ হিন্দি অনুবাদ ধরা যায় তবে সেটা ঘটেছিল পঙ্কজ মল্লিকের হাত ধরেই। জার্মান পরিচালক পল জিলস 'চার অধ্যায়' অবলম্বনে তৈরি করেন 'জলজলা' (১৯৫২)। ওই ছবিতে কে এল সায়গল গেয়েছিলেন 'পবন চলে জোর' যা হল 'খর বায়ু বয় বেগে'-র হিন্দি ভাবানুবাদ। ঠিক যেমন তিরিশের দশকে নিতান্ত খেটে-খাওয়া বাঙালির ঘরে ঘরে রবি ঠাকুরের গানকে পৌঁছে দিয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, তেমনই বাংলার বাইরের মানুষের মনেও ঢেলে দিয়েছিলেন রবির সুর ও গান। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া কি আর রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়? তাই এই দিনটিতে একবার স্মরণ করতেই হয় রবির পরশ লাগা এই মানুষটিকে।