আট কিংবা নয়ের দশকে পরিচালক অঞ্জন চৌধুরির ছবি মানেই পারিবারিক গল্প। প্রেম-বিচ্ছেদ, সাংসারিক পলিটিকস, আদ্যোপান্ত বিনোদনের মোড়কে ফেমিলি মেলোড্রামা। 'বড় বউ', 'মেজো বউ', 'ছোট বউ' থেকে শুরু করে 'গুরুদক্ষিণা', 'শত্রু', 'প্রতিবাদ'-এর মতো একাধিক হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। বাবার হাত ধরে সেইসময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখেন তাঁর দুই মেয়ে চুমকি চৌধুরি ও রিনা চৌধুরি। কখনও লাঞ্ছিতা স্ত্রীয়ের ভূমিকায় আবার কখনও বা প্রেমিকা কিংবা আদুরে বোনের ভূমিকায় নজর কেড়েছেন দুই বোন। বাবা অঞ্জনের সুবাদে শৈশব থেকেই লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের সঙ্গে পরিচয়। দুই বোনের ব্যস্ততাও তখন থাকত তুঙ্গে। কিন্তু যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন মুখের ভীড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন চুমকি-রিনা। বড় বোন চুমকিকে যদিও বা টেলিপর্দায় দেখা যায়। ছোট বোন রিনা অনেকদিন আগেই সরে দাঁড়িয়েছেন ক্যামেরার সামনে থেকে। এখন অবশ্য পরিচালনাতেই মন দিয়েছেন তিনি। কেমন ছিল সেইসময়কার টলিপাড়া? স্মৃতির সরণিতে হেঁটে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার নতুন সিরিজ 'পুরনো সেই দিনে কথা'য় নস্ট্যালজিক হয়ে পড়লেন রিনা-চুমকিরা।
একসময়ে সিনেমার পরিচিত মুখ ছিলেন পরিচালক অঞ্জন চৌধুরির দুই মেয়ে চুমকি ও রিনা। এখন আর ইন্ডাস্ট্রিতে সেভাবে দেখা যায় না। অনেকেই ইন্ডাস্ট্রিতে স্বজনপোষণের অভিযোগ তুলেছেন। সেই প্রেক্ষিতে অঞ্জন-কন্যা হিসেবে কতটা সুবিধে পেয়েছিলেন রিনা-চুমকি? প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই রিনা থামিয়ে দিয়ে বললেন, "অনেকেই বলেন, বাবা ছিল বলেই আমরা সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু নেপোটিজম বিষয়টাই যুক্তিযুক্ত নয়। তাই যদি হত, তাহলে আমরা থাকাকালীনও বাবা অন্য কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রীকে সিনেমায় কাস্ট করতেন না কিংবা সুযোগও দিতেন না। উনি তো নিজে হাতে কতজনের কেরিয়ার গড়েছেন। স্টারকিডরা এমনিতেই প্রচারের আলোয় থাকে। এই তো শুভশ্রীর সন্তান ইউভানকেই ধরুন। ওকে নিয়ে অনুরাগীদের মধ্যে কত উন্মাদনা। আমাদের সময়েও সেটাই কাজে লেগেছিল। অঞ্জন চৌধুরির দুই মেয়ে সিনেমা করছেন- এটা শুনেই অনেকে ছবি দেখতে গিয়েছেন। আমাদের পরিবারে নেপোটিজম বিষয়টাই ছিল না। এখনও নেই। ভাই সন্দীপ চৌধুরিও তো অনেক সিরিয়াল পরিচালনা করছে, সেরকমই যদি হত তাহলে তো ভাইও আমাদের কাস্ট করতে পারত!"
চুমকি-রিনারা তাঁদের প্রজন্মের নায়িকাদের মধ্যে 'ক্যাটফাইট'-এর অস্তিত্ব মানতেই নারাজ। অভিনেত্রীদের পাশাপাশি অভিনেতাদের সঙ্গেও দুই বোনের খুব ভাব ছিল। তাপস পাল, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়রা ছিলেন একেবারে দাদার মতো। ঠাট্টা করে চুমকি বললেন, "বুম্বাদা, তাপসদা যদি একসঙ্গে গল্প করত, আমাদের ঘর থেকে বের করে দিত। বলত- এই যা তো, তোদের এসব কথা শুনতে হবে না।" নস্ট্যালজিক রিনার মন্তব্য, "এরকমও হয়েছে যে আমি বুম্বাদার খাটে শুয়ে জিতেন্দ্রর সিনেমা দেখছি, আর ও মেঝেতে বসে চেঁচাচ্ছে- বুকাই সর আমাকে দেখতে দে! ভিসিআর-টা কি আমি তোর জন্য ভাড়া করে এনেছি?"
আরও পড়ুন ‘আমি ফুলঝুরিও নই, কালিপটকাও নই..’, ‘উড়ন তুবড়ি’র প্রোমোতেই শোরগোল, দেখুন
দুই নায়িকার কাছে তাঁদের 'রঞ্জিতকাকু (মল্লিক)' পিতৃস্থানীয়। চুমকি বলছিলেন, "একেবারে ছোট থেকেই তো চিনি। তখন থেকেই উনি ঠাট্টা করে বলতেন, নায়িকা হবি? পরে বলেছিলাম- দেখো নায়িকা হয়েই দেখালাম।" আজ যদি কোনও দরকার হয় কিংবা বিপদে পড়েন, রাত ২ টো হলেও রিনা-চুমকির ফোন যাবে ইন্ডাস্ট্রির দু'জনের কাছে। এক, হরনাথ চক্রবর্তী এবং দ্বিতীয়ত শ্রীলা মজুমদারের কাছে।
সন্ধ্যা রায়ের কাছ থেকে তাঁরা শিখেছেন গ্লিসারিন ছাড়া কীভাবে কাঁদতে হয়। চুমকি বললেন, "একবার অনুপজেঠু (কুমার) শুটের ফাঁকেই ডেকে বললেন, হ্যাঁ রে চুমকি, তুই এতবার চোখের পাতা ফেলিস কেন? কখনও ভেবেছিস, বড়পর্দায় যখন দর্শকরা দেখবে, কীরকম খারাপ লাগবে দেখতে!"
টলিউডে লবি-বাজির অভিযোগ প্রসঙ্গ উঠতেই ঘাড় নাড়িয়ে চুমকির মন্তব্য, "সেই প্রসঙ্গে মুখ না খোলাই ভাল।" পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রির এখনকার তারকাদের অনায়াসে রাজনীতিতে প্রবেশ করার বিষয়টিকে খুব একটা ভাল চোখে দেখেন না দুই বোনের কেউই। চুমকি জানালেন, "আমার কাছে বড় বড় জায়গা থেকেও প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু আমি সপাটে না করে দিয়েছি। কোনওদিন কোনও দলের হয়ে প্রচারে নামিনি। নামবও না।" দিদির মন্তব্যে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে রিনাও বুঝিয়ে দিলেন যে, তারকাদের রাজনীতি করার বিষয়টি তাঁদের একেবারেই না-পসন্দ।
সুযোগ পেলে কখনও বাবা অঞ্জন চৌধুরির 'শত্রু' ছবির রিমেক করতে চান চুমকি চৌধুরি। কথাপ্রসঙ্গেই দুই বোন জানালেন, একটা সময়ে নাকি অঞ্জন পরিচালিত কোনও ছবির ক্যাসেট পাওয়া যেত না। টালিগঞ্জের নামকরা দোকানগুলোতে তিন-চারবার ঘুরেও পাননি। কারণটা অবশ্য এক দোকানদার খোলসা করেছিলেন। কী? রিনা বললেন, "ওই দোকানদার আমাকে বলেছিল, অঞ্জন চৌধুরির সিনেমার ক্যাসেট সবাই নিয়ে যায়। অনেকে সেই গল্প নকল করেই সাফল্য পেয়েছেন। তবে ইন্ডাস্ট্রির কে বা কারা নিতেন? সেই খোঁজ আমরা কখনও করিনি।"
দিন কয়েক আগেই মৈনাক ভৌমিক পরিচালিত 'একান্নবর্তী' ছবির একটি সংলাপ নিয়ে বেজায় অপমানিত বোধ করেছিলেন রিনা-চুমকিরা। সেই প্রসঙ্গেও সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন ছোট বোন রিনা।
বাংলার পাশাপাশি বাংলাদেশেও বাবা অঞ্জন চৌধুরির সিনেমার প্রচুর দর্শক ছিল। এবং এখনও সেখানে অনেকেই বাবার কোনও সিনেমার নাম বললেই চিনতে পারেন। চুমকি বলছিলেন, "করোনার আগেই যখন বাংলাদেশে গেছিলাম প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি ওখানকার মানুষদের কাছ থেকে।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন