চাঁদ নিয়ে কবির কল্পনা কোটি কোটি! চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো… আহা, এ গান গাইলে বা শুনলে হৃদমাঝারে চাঁদের আলো পা-ছড়িয়ে বসবেই। জ্যোৎস্নারাতে সবাইকে নিয়ে বনে যাওয়ার সাধও হতে পারে (সাহস হয়তো নাও থাকতে পারে)। আবার বিঠোফেনের মুনলাইট সোনাটার কথাও বলা যেতে পারে চাঁদ প্রসঙ্গে। যে সে মিউজিক নয় দাদা, যাঁরা শোনেননি তাঁদের মানবজীবন বোধ হয় সাহারা (শিহরণ শূন্য)। চাঁদ নিয়ে ফিল্মও হয়েছে। ছবির সেই আদি যুগে মিলিয়েসের সাইলেন্ট মুভি-- চন্দ্রাভিযান, ১৯০২ সালের ছবি, আ ট্রিপ টু দ্য মুন। নাহ, এ রোম্যান্টিকতা নয়, চাঁদের সঙ্গে একটি ভয়ঙ্কর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা ফেঁদে বসতে হচ্ছে। নাম চাঁদের দোলন।
কিছু দিন আগে নাসার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালে। আগামী দশকে বন্যার আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয় সেখানে। চাঁদের দোলনকাল এবং জলবায়ু পরিবর্তন দুয়ের যুগলবন্দিতেই এমনটা ঘটবে বলে অনুমানের বৈজ্ঞানিক ভাষ্য লেখা হয়েছে সেখানে। তাতেই হইচই পড়ে গিয়েছে দিকে দিকে। চাঁদ একেবারে কাঠগড়ায় হাজির।
চাঁদের দোলন কী বস্তু?
না, চাঁদের এই দোলন নতুন কিছু নয়। বহু যুগ ধরেই তা চাঁদের সঙ্গে, পৃথিবীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে। এই দোদুল্যমান টানাপোড়েনে জল স্ফীত হয়ে ওঠে সমুদ্রের, কিংবা সংকুচিত হয়ে যায়। সাধারণ জোয়ারভাটার সঙ্গে একটা নয়া মাত্রা যোগ বলা যেতে পারে। যদিও পরিবেশ দূষণের যে বিশ্লেষণটা করা হয়েছে ওই নিবন্ধে, তা যেন চাঁদের ও-পিঠের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। শুধু চাঁদের দোলন নিয়ে মাতামাতি করা হচ্ছে। চাঁদ-ভিলেনের দিকে বন্দুক তাক করে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন নিশ্চিত কেউ কেউ। সবই যে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্রে হল ব্যথা, বুঝছেন কী!
নাসা বলেছে, চাঁদের দোলনের মধ্যে নতুন কিছু নেই। ১৭২৮ সালে এমনটা জানা যায়। বোঝা যায়, পৃথিবীর উপর চাঁদের টানের খেলাটা। সংযোজন হল-- গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন। এবং তাতেই ভয়ঙ্কর বন্যার ভ্রুকুটি। সাগরতীরে ভিটেমাটি সব চাঁটি হয়ে যাওয়ার হাঁটু-কাঁপা হাহাকার শুরু। তবে, সতর্কতা বেশি জরুরি। চিন্তাটা অমূলক নয় মোটেই।
আরও পড়ুন বাজ কেন পড়ে, কেন-ই বা মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে বজ্রপাত?
কোথা থেকে এই দোলন-এর আবির্ভাব?
শিশুপাঠ্যেই আছে, জোয়ার-ভাঁটার জন্য চাঁদের টানই সিংহ ভাগ দায়ী। বেশির ভাগ সাগরবেলাতে ২৪ ঘণ্টায় দু-বার জোয়ার দেখা যায়। উল্টোটাও হয় একই ভাবে। চাঁদ পৃথিবীকে মোটামুটি এক মাসে এক বার ঘোরে। চাঁদের কক্ষপথ একটু বাঁকা। আরও স্পষ্ট ভাবে বললে, পৃথিবীকে সূর্য যে কক্ষপথে ঘোরে তার সঙ্গে চাঁদের এই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণপথ ৫ ডিগ্রি কোণ করে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কারণেই চাঁদের কক্ষপথে চাঞ্চল্য দেখা যায়। ধীরে ধীরে সরতে সরতে পূর্বাবস্থায় ফেরে কক্ষপথ, একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়, যাকে বলা যেতে পারে সংযোগ-বৃত্ত, বা নোডাল সাইকেল। এর জন্য লাগে ১৮.৬ বছর। 'চাঁদের দোলনের চেয়ে চন্দ্রায়ন শব্দটা এখানে বেশি লাগসই। যা খুবই ধীরে ধীরে হতে থাকে।' বলছিলেন বেঞ্জামিন ডি হ্যামলিংটন, যিনি নাসার গবেষণা-প্রবন্ধের অন্যতম লেখক এবং নাসার সমুদ্রতল পরিবর্তন সংক্রান্ত দলের প্রধান।
চন্দ্রায়নের এই কালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে চাঁদ পৃথিবীর বেশি কাছে পৌঁছে যায়, এবং তার টানে জল যেমন স্ফীত হয়ে থাকে জোয়ারে, তার চেয়ে স্ফীতি একটু বেশি হয়। এর সঙ্গে উষ্ণায়ন জুড়ে বন্যার বড় আশঙ্কার সূত্রপাত। 'আমরা এই নিবন্ধের মাধ্যমে নোডাল সাইকেল নিয়ে যা বলতে চেয়েছিলাম, তা একটু অন্য ভাবে পৌঁছেছে সাধারণের কাছে।' বললেন হ্যামলিংটন। 'তবে ব্যাপারটি যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে কিন্তু।' আর চন্দ্রায়ন বিশেষজ্ঞ ম্যাকনল্ডি বললেন, 'একটা সময় চাঁদের টানে সমুদ্রতল অনেকটা উপরে উঠে যায়, যেমন হবে আগামী দশকের মাঝামাঝি, আবার এখন আমরা ডাউনওয়ার্ড ফেজে আছি, মানে জলস্তর এখন নীচুতে।'
অস্থিরতার আরও কথা
চন্দ্রের টান নানা রকম, তাই চন্দ্রায়ন বা চাঁদের এই কক্ষপথের স্খলনকালের প্রভাবও সর্বত্র এক হবে না। এক থেকে দু' ইঞ্চি ঢেউয়ের উচ্চতার কমবেশি হবে এই সময়। এই বৃদ্ধিটাই দুশ্চিন্তার। ফিলিপ থম্পসন, যিনি এই গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক, বললেন, 'এটা বুঝতে হবে ৩০-এর দশকের মধ্যবর্তী বিন্দুতে সাধারণ নোডাল সাইকেল সমুদ্রতলের বিরল স্ফীতির জন্য দায়ী থাকবে, তখন আমরা দ্রুত লয়ে নানা পরিবর্তন দেখতে পাব।'
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন