ভারতীয় সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি কার্যকর করা হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয়। সকলেই জানেন যে ভারতীয় সংবিধান তৈরিতে বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের একটি বড় ভূমিকা ছিল। তিনি দেশের সংবিধানের স্রষ্টা হিসাবে পরিচিত। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না সেই মহান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে যারা সংবিধান প্রণয়নে বাবা সাহেবকে সাহায্য করেছিলেন। গণপরিষদে মোট ৩৭৯ জন সদস্য ছিলেন। তার মধ্যে ১৫ জন মহিলা দেশের জটিল সংবিধান তৈরিতে তাদের অমূল্য অবদান রেখেছিলেন। ভারতীয় সংবিধানে নারীদের প্রতিনিধিত্বকারী এই 'মাতৃশক্তি' সম্পর্কে শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বের জানা উচিত।
সংবিধান রচনায় যে ১৫ মহিলা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম লীলা রায়। আমাদের সকলেরই জানা সংবিধানের প্রণেতা বি আর আম্বেদকর। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না এদেশের বিশাল এবং জটিল সংবিধানটি রচনার পিছনেও রয়েছেন ১৫ জন মহিলা। লীলা রায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
লীলা রায় ১৯০০ সালের ২রা অক্টোবর মাসে অসমের গোয়ালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি ১৯২১ সালে বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক হন। ১৯২৩ সালে, তিনি তিনি 'দীপালি সংঘ' প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি 'স্কুল প্রতিষ্ঠা' করেন। যা রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তীতে, ১৯২৩ সালে, ঢাকা ও কলকাতায় মহিলা ছাত্রদের সংগঠন 'ছাত্রী সংঘ' প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি 'জয়শ্রী' নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক হন।
লীলা রায় ছিলেন পেশায় সাংবাদিক। ১৯২১-এ তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পদ্মাবতী স্বর্ণ পদক লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রিধারী। ১৯৪১-এ নেতাজির অন্তর্ধানের পর তিনি ও তার স্বামী অনিল রায় উত্তর ভারতে ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠনের দায়িত্ব নেন। তিনি মহিলা সমাজের মুখপত্র হিসেবে ১৯৩১ -এর মে মাসে “জয়শ্রী” নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। ১৯৪৭ সালে জাতীয় মহিলা সমিতি গঠন করেন তিনি।
সংবিধান প্রণয়নে অবদান
১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি বাংলা থেকে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন । তবে কয়েক মাস পরে দেশভাগের প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতায় দাঙ্গার শিকার হওয়া মানুষদের সাহায্যে প্রাণপাত করেন এবং নোয়াখালীতে ন্যাশনাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট ফর রেসকিউ অ্যান্ড রিলিফ ওয়ার্ক তৈরি করেন। তিনি উদ্বাস্তুদের অধিকারের দাবিতে তাঁর লড়াই চালিয়ে যান।
নারীশিক্ষার বিস্তার
পূর্ববঙ্গে নারীশিক্ষা বিস্তারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। শিক্ষাজীবনেই তিনি নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিখিল বঙ্গ নারী ভোটাধিকার সংগঠনে কাজ শুরু করেন। তিনি এই সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন জনসভার আয়োজন করেন। তিনি নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ‘দীপালি সঙ্ঘ’ নামে নারীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংঘের সদস্যদের নিয়ে ‘দীপালি স্কুল’ ও ১২টি ফ্রি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নারীশিক্ষা মন্দির ও শিক্ষাভবন নামেও দুটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলগুলোয় পূর্ববঙ্গে নারীশিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন
নারীশিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি নারীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলাও দীপালি সঙ্ঘের অন্যতম কাজ ছিল। অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মতো বিপ্লবীও তা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি মহিলা সমাজের মুখপত্র হিসেবে ১৯৩১ সালের মে মাসে ‘জয়শ্রী’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর তাকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
মালতী চৌধুরী
মালতী চৌধুরী ১৯০৪ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বর্তমানে বাংলাদেশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে মালতী চৌধুরীকে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয় যেখানে তাকে বিশ্বভারতীতে ভর্তি করা হয়। সত্যাগ্রহের সময়, মালতী চৌধুরী তার স্বামীর সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কৃষকদের অধিকারের জন্য আওয়াজ তুলেছিলেন। তিনি দেশের প্রথম মহিলা মার্কসবাদী নেতাদের মধ্যে ছিলেন। দরিদ্র কৃষক ও আদিবাসীরা তাকে 'উড়িষ্যার মা' নাম দিয়েছিলেন।
আম্মু স্বামীনাথন
আম্মু স্বামীনাথন কেরলেরর পালঘাট জেলার আনাকারায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৬ সালে মাদ্রাজ নির্বাচনী এলাকা থেকে গণপরিষদের সদস্য হন। ২৪ নভেম্বর ১৯৪৯ সালে খসড়া সংবিধান পাস করার জন্য তার বক্তৃতায়, আম্মু বলেছিলেন, 'বাইরে থেকে লোকেরা বলছে যে ভারত তার মহিলাদের সমান অধিকার দেয়নি। এখন আমরা বলতে পারি যে ভারতীয় জনগণ যখন নিজেরাই তাদের সংবিধান তৈরি করছে তখন তারা দেশের অন্যান্য নাগরিকের মতো নারীদের সমান অধিকার দিয়েছিল'। ১৯৫২ সালে লোকসভায় এবং ১৯৫৪ সালে রাজ্য সভায় মনোনীত হন তিনি।
বেগম আইজাজ রসুল
গণপরিষদে একমাত্র মুসলিম মহিলা ছিলেন বেগম আইজাজ রসুল। ১৯৫০ সালে ভারতে মুসলিম লীগ বিলুপ্ত হলে বেগম আইজাজ কংগ্রেসে যোগ দেন। এর পরে, তিনি ১৯৫২ সালে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত উত্তর প্রদেশ বিধানসভার সদস্য ছিলেন। বেগম আইজাজ রসুল ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সমাজকল্যাণ ও সংখ্যালঘু দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২০০০ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন।
দুর্গাবাঈ দেশমুখ
দুর্গাবাঈ দেশমুখ ১৫ জুলাই ১৯০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে তিনি সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত ছিলেন। ১৯৩৬ সালে, দুর্গাবাঈ অন্ধ্র মহিলা সভা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ বোর্ড, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ এবং গার্লস অ্যান্ড উইমেনস এডুকেশন জাতীয় কমিটির মতো কেন্দ্রীয় সংগঠনের চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে, দুর্গাবাঈকে ভারতে সাক্ষরতা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদানের জন্য চতুর্থ নেহেরু সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পরে ১৯৭৫ সালে, দুর্গাবাঈ দেশমুখ পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন।
দক্ষিণী বেলায়ুদান
দক্ষিণী বেলায়ুদান ১৯১২ সালের ৪ জুলাই কোচির বলগাট্টি দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সমাজের শোষিত-বঞ্চিত শ্রেণীর নেত্রী। ১৯৪৫ সালে, তাকে রাজ্য সরকার কোচি আইন পরিষদে মনোনীত করেছিল। এক বছর পরে, ১৯৪৬ সালে, প্রথম এবং একমাত্র দলিত মহিলা গণপরিষদে নির্বাচিত হন।
কমলা চৌধুরী
কমলা চৌধুরী উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌ জেলার এক সমৃদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। কমলা চৌধুরী সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন এবং লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। কমলা চৌধুরীও একজন বিখ্যাত লেখিকা ছিলেন, যাঁর গল্পগুলি ছিল মহিলাদের উপর ভিত্তি করে।
হংসা জিভরেজ মেহেতা
হংসা জিভরেজ মেহেতা ৩ জুলাই ১৮৯৭ সালে বরোদায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্রিটেনে সাংবাদিকতা ও সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরে ভারতে একজন সংস্কারক ও সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তিনি একজন শিক্ষিকা এবং লেখিকাও ছিলেন। ১৯২৬ সালে, তিনি বোম্বে স্কুল কমিটিতে নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে, তিনি সর্বভারতীয় মহিলা সম্মেলনের সভাপতি হন।
অমৃত কৌর
অমৃত কৌর ১৮৮৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি লখনউতে জন্মগ্রহণ করেন। অমৃত কৌর ছিলেন কাপুরথালার প্রাক্তন মহারাজার পুত্র হরনাম সিংয়ের কন্যা। অমৃত কৌর ভারতের যক্ষ্মা অ্যাসোসিয়েশন এবং সেন্ট্রাল লেপ্রসি অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি রেড ক্রস সোসাইটির গভর্নর বোর্ডের ভাইস-চেয়ার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং সেন্ট জন অ্যাম্বুলেন্স সোসাইটির নির্বাহী কমিটির সভাপতিত্ব করেন। পরবর্তীতে, ১৯৬৪ সালে অমৃত কৌরের মৃত্যুর পর, নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে দেশে সেবার জন্য 'রাজকুমারী' উপাধি দেয়।
সরোজিনী নাইডু
সরোজিনী নাইডু ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৯ সালে হায়দ্রাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। সরোজিনী নাইডুকে 'ভারতের নাইটিঙ্গেল'ও বলা হয়। সরোজিনী নাইডু ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম ভারতীয় মহিলা সভাপতি।
রেনুকা রায়
আইসিএস সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও চারুলতা মুখোপাধ্যায়ের কন্যা রেনুকা রায়। রেণুকা লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে বিএ সম্পন্ন করেন। তারপরে তিনি ১৯৩৪ সালে আইন সচিব হিসাবে কাজ করেন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত রেণুকা কেন্দ্রীয় আইনসভা, গণপরিষদ এবং অস্থায়ী সংসদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত, রেণুকা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
সত্যাগ্রহ ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলে যান। তাকে এলাহাবাদে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কমিটির সেক্রেটারি করা হয়।
অ্যানি মাস্কারেন
অ্যানি মাসকারেন ল্যাটিন ক্যাথলিক পরিবারের জন্ম নেন। অ্যানিই প্রথম মহিলা যিনি ত্রাভাঙ্কোর রাজ্য থেকে কংগ্রেসে যোগ দেন। অ্যানি মাসকারেন পরবর্তীতে ত্রাভাঙ্কোর রাজ্য কংগ্রেস কার্যনির্বাহী দলের প্রথম মহিলাও হন। ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে তাকে কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছে। এই সময়ে, অ্যানি ১৯৫১ সালে ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো লোকসভায় নির্বাচিত হন। তিনি কেরলে প্রথম মহিলা সাংসদও ছিলেন।
সুচেতা কৃপালানি
হরিয়ানার আম্বালায় ১৯০৮ সালে জন্মগ্রহণকারী সুচেতা কৃপালানি স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হন। ১৯৪০ সালে, কংগ্রেস মহিলা শাখা সুচেতা কৃপালানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। তার রাজনৈতিক কর্মজীবনে, সুচেতা কৃপালানি নয়াদিল্লির সাংসদ এবং উত্তর প্রদেশের শ্রম, সম্প্রদায় উন্নয়ন ও শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিজয়া লক্ষ্মী পণ্ডিত
বিজয়া লক্ষ্মী পণ্ডিত ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বোন। তিনি এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন, যেখান থেকে তিনি এলাহাবাদ মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে, বিজয়া লক্ষ্মী পণ্ডিত ইউনাইটেড প্রভিন্স অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি দেশের একজন মহিলা ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়েছিলেন।