সুদীপ্তা সেনগুপ্ত, আটের দশকের বঙ্গ জীবনের আলোচনায় উঠে আসত তাঁর নাম। প্রথম বাঙালি এবং যুগ্মভাবে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে আন্টার্কটিক বা ১৯৮৩-তে দক্ষিণ মেরু অভিযানে গিয়েছিলেন তিনি। সুদীপ্তার পরিচিতি কিন্তু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্রাকচারাল জিওলজির অধ্যাপিকা হিসেবেও দায়িত্ব সামলেছেন দীর্ঘদিন। তা ১৯৮৩ সালে বরফদেশে পা রাখা মানুষটার কথা কেন ২০১৮-তে আবার উঠে আসছে? এই প্রশ্নটা আসতেই পারে। আসলে ৩৫ বছর পর ফের এক বাঙালি মেয়ে পা রাখতে চলেছেন বিশ্বের শীতলতম, শুষ্কতম মহাদেশে। কলকাতার মডেল মাধবীলতা মিত্র যাচ্ছেন দক্ষিণ মেরুতে।
১৯৬২ সালে উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পর রক ক্লাইম্বিং শিখেছিলেন সুদীপ্তা। ছ’বছরের মধ্যে বেসিক এবং অ্যাডভান্সডটাও শিখে নেন বালিগঞ্জের বাসিন্দা। বাকিটা ইতিহাস। সুদীপ্তা কিন্তু দ্বিতীয়বারের জন্য আন্টার্কটিকে গিয়েছিলেন ১৯৮৯-তে। নিজের প্রথমবারের কাজে তিনি খুশি ছিলেন না। ফলে দ্বিতীয়বার গিয়ে অসম্পূর্ণ কাজ সেরে আসেন। কেন্দ্রীয় সরকার সুদীপ্তাকে আন্টার্কটিক পুরস্কার এবং ন্যাশনাল মিনারেল পুরস্কারে ভূষিত করে। বিজ্ঞানে অবদানের জন্য ভাটনগর পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। আজও আন্টার্কটিকের কথা বললে সুদীপ্তাকে ছাড়া তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ক্যান্টিনে কফিতে চুমুক দিয়ে সুদীপ্তা শোনালেন তাঁর রুদ্ধশ্বাস অভিযানের গল্প। উজাড় করে দিলেন অভিজ্ঞতার ঝুলি। সাক্ষী থাকল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।
কীভাবে শুরু হয়েছিল ভাল লাগাটা?
সুদীপ্তা: আমার বাবা (জ্যোতি রঞ্জন সেনগুপ্ত) নেপালে পোস্টেড ছিলেন। এখনও মনে আছে আমি কাঠমাণ্ডুতে দাঁড়িয়ে তেনজিং নরগে আর এডমন্ড হিলারির বিজয় মিছিল দেখেছিলাম, ভারতীয় দূতাবাসেও তেনজিংদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছিলাম। তখন থেকেই মনে হতো, এরকমটা আমিও যদি করতে পারতাম। আর ছোট থেকেই প্রচুর ঘুরতাম। ভাল লাগা একটা ছিলই।
বাড়ির ভূমিকার কথা আপনি বলেছেন বারবার...
সুদীপ্তা: অবশ্যই, মা-বাবার উৎসাহ না থাকলে এসব সম্ভবই হত না। বাবা চাইতেন মেয়ে সায়েনটিস্ট হোক, মা চাইতেন আমি এরকম ঘুরি। দুইয়ের মেলবন্ধনে জিওলজি বেছে নেওয়া। এখানে ফিল্ড স্টাডির জন্য প্রচুর ঘোরার সুযোগও থাকে। বাবা একটা কথাই বলতেন, মন দিয়ে পড়াশোনা করলে এমনিই সব ঠিক হয়ে যাবে। সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি আমি। একেক সময় মনে হয় আমি কতটা লাকি ছিলাম, যে আজ থেকে ৫০ বছর আগেও আমারা মা-বাবা এরকম স্বাধীনচেতা ছিলেন।
আরও পড়ুন: পেঙ্গুইন দেখা নয়, দেশের প্রতিনিধিত্ব করাটা বড় ব্যাপার: মাধবীলতা
অভিযানের কথা বললে প্রথমেই মাথায় কোনটা আসে?
সুদীপ্তা: ১৯৬৭-তে আট জন বাঙালি মেয়ে মিলে রন্টি এক্সপিডিশনে গিয়েছিলাম। খুব ভুল না হলে ওটাই ছিল দেশের প্রথম 'অল উইমেন এক্সপিডিশন'। গাড়োয়ালের একটা শৃঙ্গ আরোহণ করেছিলাম আমরা। এরপর ১৯৭০-এ দ্বিতীয় অভিযানে যাই। সেবারও দলে আমাকে নিয়ে ছ’জন মহিলা ছিলেন। লাহুলের একটা ভার্জিন পিক ছিল। প্রায় ২০,০০০ ফুট উুঁচু। যেহেতু আমরা মেয়েরা গিয়েছিলাম, তাই নাম দিয়েছিলাম মাউন্ট ললনা।
১৯৭০-এর পর থেকে দীর্ঘ সময় মাউন্টেনিয়ারিং থেকে দূরে ছিলেন। কারণটা কী?
সুদীপ্তা: মাউন্ট ললনা থেকে ফেরার পর আমি পিএইচডি শুরু করি। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে চাকরিও পেয়ে যাই। ১৯৭২-এ পিএইচডি-র ফিল্ড ওয়ার্ক শেষ করে কাগজপত্র জমা দিয়েছিলাম। এরপর ১৯৭৩ সালে আমি প্রথম মহিলা এবং প্রথম জিওলজিস্ট হিসেবে সাম্মানিক 'রয়্যাল কমিশন ফর দ্য এক্সিবিশন অফ এইটটিন ফিফটিওয়ান ফ্রম ইউকে' স্কলারশিপ পাই। এরপর পোস্ট ডক্টরেট কাজের জন্য বিদেশে চলে গেলাম। ১৯৭৩-৭৬ পর্যন্ত লন্ডনেই ছিলাম। ইমপেরিয়াল কলেজে কাজ করছিলাম। ১৯৭৭-এ সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছিলাম। ওখানে দু'বছর ছিলাম।, ভিজিটিং সায়েনটিস্ট হিসেবে ইন্টারন্যশনাল জিও-ডায়নামিক্স প্রোজেক্টে কাজ করতাম। দেশে ফিরে ১৯৮২-তে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে সিনিয়র জিওলজিস্ট হিসেবে যোগ দিই।
আন্টার্কটিক অভিযানের ইতিহাসটা যদি বলেন...
সুদীপ্তা: জিও-ডায়নামিক্স প্রোজেক্টের জন্যই স্কটিশ হাইল্যান্ড এবং ক্যালিডোনাইটস ঘুরেছি। দিনের শেষে কাজের পর যখন অনান্য সায়েনটিস্টদের সঙ্গে এক টেবিলে বসতাম, ওদের মুখেই শুনতাম আন্টার্কটিকের গল্প। ছোটবেলায় বইতেও পড়েছিলাম। বরাবরই আগ্রহ ছিল। ওদের আলোচনাটাই আরও বেশি করে আন্টার্কটিক-মুখী করে তোলে আমায়। ১৯৮১-তে প্রথম আন্টার্কটিক এক্সপিডিশন হয়। এর পরের বছর আমি আবেদন পাঠাই ডিপার্টমেন্ট অফ ওসেন ডেভেলপমেন্টে। এখন এটাই ন্যাশনাল সেন্টার ফর আন্টার্কটিক রিসার্চ বলে পরিচিত। কিন্তু ওরা আমার আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল, মেয়ে বলে। কারণ ওদের কোনও সায়েনটিস্টই মহিলা নন। এরপর একদিন দেখলাম টেলিগ্রাম এসেছে। আমাকে দিল্লিতে ডাকা হয়েছিল ইন্টারভিউয়ের জন্য়। মেডিক্যাল থেকে শুরু করে সব পরীক্ষাই আমি পাশ করেছিলাম।
অভিযানের সম্বন্ধে কিছু বলুন। প্রথম আন্টার্কটিক দেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল!
সুদীপ্তা: ১৯৮৩-র ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ ছিল ওটা, দিনটা ঠিক মনে নেই। আমরা গোয়া থেকে জলপথে যাত্রা শুরু করি। ফিনপোলারিস নামের আইস-ব্রেকার জাহাজে করে রওনা দিয়েছিলাম প্রথমবার। ৮০ জনের টিম গিয়েছিল। ৩০ জন বিজ্ঞানী ( তাঁদের মধ্যে সমুদ্রবিজ্ঞানী অদিতি পন্থ, সুদীপ্তার সঙ্গে যৌথভাবে আন্টার্কটিকে প্রথম ভারতীয় মহিলা) ৪০ জন সেনা কর্মী, ১৭ জন বায়ুসেনা কর্মী, এবং বাকিরা নৌসেনার। ২৯ দিন লেগেছিল ফার্স্ট আইসে পৌঁছতে। গিয়ে মনে হয়েছিল, যেন চাঁদে চলে এসেছি। এ তো পৃথিবীর বাইরের কোনও জায়গা! পেঙ্গুইন ঘুরছে চারদিকে। যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। চকচক করছে। সূর্য একেবারে মাথার ওপরে। বলে বোঝানো যাবে না সেই অভিজ্ঞতা।
আন্টার্কটিক নিয়ে লেখা আপনার বই বেস্টসেলার হয়েছিল, আর কিছু লেখার কথা ভাবছেন?
সুদীপ্তা: সত্যি বলতে, ওই অভিজ্ঞতা না লিখে বলা যেত না। বইটার এখনও চাহিদা আছে। এটা বুঝতে পারি যখন বছরে বেশ ভাল টাকার রয়্য়ালটি পাই! ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন দাম ছিল ৬০ টাকা। আবারও বই লেখার ইচ্ছা আছে। তবে এবার আর আন্টার্কটিক নিয়ে নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ফিল্ড ওয়ার্কের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই। এখনও মনে আছে ক্যালিডোনাইটেসর কথা। সেএক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। হেলিকপ্টারে করে আমাদের পাহাড়ের টিলায় ছেড়ে দিয়ে যেত। ম্যাপ ওয়ার্কে দু’জন করে যেতাম। দশ দিন করে থাকতাম। থাকা খাওয়া সব ওই চূড়াতেই। আবার হেলিকপ্টার নিয়ে যেত।
আন্টার্কটিক থেকে ফেরার পর বিশেষ কোনও ঘটনার কথা মনে পড়ে?
সুদীপ্তা: অনেক চিঠি পেতাম। এখনও মনে আছে, একজন ৮০ বছরের মহিলা আমার প্রশংসায় সনেট লিখেছিলেন। কোনওদিন ভুলব না সেটা। এছাড়াও ২৪-২৫ বছরের একজন গৃহবধূ চিঠিতে জানান, তিনি একই বাংলায় থেকে নিজের শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরনোর অনুমতিই পান না। সেখানে আমি এই কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললাম।
আরও পড়ুন: ব্রিটেনের বিশ্বজয়ীর নেতৃত্বে বরফ সাম্রাজ্য অভিযানে দুই ভারতীয় কন্যা
মাধবীলতার কথা তো শুনেছেন, ওঁর জন্য কী বার্তা থাকবে?
সুদীপ্তা: এটাই বলব যে, মাধবীলতারা চুটিয়ে উপভোগ করুক। সাবধানতা, সতর্কতা অবলম্বন করুক। মাথায় রাখতে হবে, প্রচণ্ড ঠান্ডা আর হাওয়ার সঙ্গে লড়তে হবে। শারীরিকের থেকেও মানসিক ভাবে অনেক বেশি ফিট থাকাটা জরুরি। ভাল হোক ওদের সফর।