জায়গাটার নাম আমি বলব না। কারণ, যাঁরা আমাকে এখানে কিছুদিন ছাড়া ছাড়া আশ্রয় দেন, তাঁরা এটা চান না। তার অর্থ এ নয়, এঁরা কোনো সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত। না, এঁরা উগ্রপন্থী নন। আমার আপনার মতই সাধারণ। কেউ কেউ সমাজের দায়িত্বশীল পদেও আছেন। তবু ভেতরে ভেতরে এঁদের মধ্যে কোথাও একটা অস্থিরতা, জীবনের প্রতি একটা সুগভীর অসন্তোষ আছে। মাঝে মাঝেই এখানে পালিয়ে আসেন। তখন এঁদের কোনো খবর বাইরের পৃথিবীর কেউ পায় না।
এখানে আসার আগে এরকম একটা জায়গা হতে পারে, জানতাম না। ঘুরতে ঘুরতে কাছেপিঠে এসে পড়েছিলাম। কিছুটা এগোতেই ‘সাঁই’ করে একটা তির মাথা প্রায় ছুঁয়ে উড়ে গেল। ব্যাপার বুঝতে পেরে তখনই দুটো হাত মাথার উপর তুলেছি; অমনি কোমরে কাপড় জড়ানো কৃষ্ণকায় অর্ধনগ্ন সশস্ত্র কয়েকজন মানুষ ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। ঘিরে ধরে প্রায় বন্দি অবস্থায় তারা আমাকে এখানে নিয়ে এল। এখানকার লোকজন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমার থেকে তাঁদের কোনো ক্ষতি হবে না জেনে এখানে কিছুদিনের জন্যে থাকতে দিয়েছিলেন। তখন বছর তিরিশেক বয়েস। সেই থেকেই মাঝে মাঝে এখানে আসি।
বিদ্যুৎ নেই। পরপর মাটির ঘর। হোগলার ছাউনি। দেওয়ালে আলকাতরার প্রলেপ। দরজা-জানালা বাঁশের। বারান্দা চাঁচ দিয়ে ঘেরা। আপাতত, তিনজন আছি। আমি, একজন অধ্যাপক এবং একজন রান্না্র লোক। এই তৃতীয় লোকটি—যে রোজ দুবেলা সানকিতে করে ভাত-তরকারি দিয়ে যায়, সে বোবা এবং কালা। ইঙ্গিতে কথা বলে এবং ইঙ্গিতেই বোঝে।
আমি শুনেছি, মধ্যে মধ্যে এখানে বিখ্যাত কেউ কেউ এসে থেকেছেন। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় এসে থাকতেন মাসের পর মাস। সেই যে-সময়টায় শহরে তাঁর কোনো খবর পাওয়া যেত না, কলকাতা থেকে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যেতেন অনির্দিষ্ট কালের জন্য। বিনয় মজুমদারও নাকি এসে ছিলেন কিছুদিন। আমি এরকমই শুনেছি। সত্যিমিথ্যে জানি না।
এখন সন্ধে। সেই মূক, বধির মানুষটি কালিপড়া হ্যারিকেন জ্বেলে দিয়ে গেছে। বিছানার চাদরটা কতো পুরোনো ধারণা নেই। ঘরের পেছনে মজা পুকুর আছে। দুপুরের দিকে ওই লাল সর-পড়া পুকুরেই স্নান সারতে হয়। পাশের বাঁশবনের দিক থেকে ঝিঁঝি পোকার ছেদহীন ডাক ভেসে আসছে। আরেকটু রাতে ঘরের পেছনে তক্ষক ডাকবে। নয়বার ‘তোক্-কে, তোক্-কে’ ডেকে থেমে যাবে। রাত আরও গাঢ় হয়ে যাবে হঠাৎই। তার একটু পরেই সেই লোকটি ভাতের থালা নিয়ে আসবে। ভাত আর একটা তরকারি। আর কিছু না। মাটির কুঁজো আছে ঘরের কোণে। লোকটা জল ভরে রেখে যায় রোজ। বিশ্বাসী লোক। তার মাইনে কে দেয়, আমি জানি না। তবে সেই কুড়ি বছর আগে যাদের হাতে বন্দি হয়ে এখানে প্রথম এসেছিলাম, তাদের আমি আর দেখিনি কোনোদিন।
সেলফোনের সঙ্গে সম্পর্ক চুকেছে। কারেন্ট নেই, চার্জ কীভাবে হবে? হাতঘড়ি আছে, সময় দেখতে পারি। সন্ধে সাড়ে সাতটা। অথচ জায়গাটা নিরন্ধ্র অন্ধকার আর নীরব, মনে হয় গভীর রাত হয়ে গেছে এখনই।
খাওয়াদাওয়া চুকে গেলে আলো জ্বেলে বসে থাকার মানে হয় না। হ্যারিকেন নিভিয়ে চাদরে মুখ-মাথা ঢেকে শুয়ে পড়ি। দূরের মাঠ থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে দেখা যায়, বাঁশবনে সবুজাভ আলোর লন্ঠন জ্বালিয়ে নিভিয়ে জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে।
আমি ছাড়া এখানে আরেকজন যে অধ্যাপক ভদ্রলোক আছেন, তাঁর ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। একসময় প্রেসিডেন্সিতে পড়িয়েছেন। এখন রিটায়ার্ড। আমার মনে হয়...মনে হয় না, আমি নিশ্চিত—তাঁর মাথাটা একটু এলোমেলো হয়ে গেছে। কতদিন এখানে আছেন, বাড়িতে তাঁর কে কে আছে, অনেক জিজ্ঞাসা করেও আমি আজও অবধি বের করতে পারিনি। বিকেলে হাঁটতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে রোজ দেখা হয়। মাথায় গোলমাল থাকলেও একসময়ে যে প্রখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন, কথা বলতে গিয়ে সেটা আমি বুঝেছি।
শালবনের ভিতর দিয়ে যে ধুলাভরা রাস্তাটা রয়েছে, সেটা ধরেই বিকেলবেলা ঘরে ফিরে আসছিলাম, ভদ্রলোকের মুখোমুখি হলাম। লম্বা, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, রোগা, গায়ে শাল আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথার চুলগুলোয় ব্যাকব্রাশ। চশমার মনে হয়, পাওয়ার অনেক বেশি। তীক্ষ্ণ, জ্বলজ্বলে চোখ। আমাকে অস্বস্তিকর চাহনিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
নমস্কারান্তে নাম জিজ্ঞেস করলাম, নাম বললেন কমল শীল। তখনই বললেন, আগে প্রেসিডেন্সিতে পড়াতেন।
নামটাকে আমি সাধারণ একটা নাম বলেই ধরে নিয়েছিলাম। শীল-পদবি তো সুলভ। আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় বাড়ি?’
আমি বললাম, ‘বাড়ি তেমন নেই এখন। আগে ছিল। মেদিনীপুরে।’
তিনি বললেন, “আমারও ওই ‘ছিল’। তবে এদিকে নয়। ওপার বাংলায়।”
—কোথায়?
কী একটা অস্পষ্ট স্থাননাম বললেন, ভালো বুঝতে পারলাম না।
আমি বললাম, ‘প্রেসিডেন্সি ছাড়া কোনো কলেজে পড়িয়েছেন?’
—কলেজে নয়, ইউনিভার্সিটিতে। নালন্দায়।
চমকাতে চমকাতে তাল সামলে নিলাম। মনে পড়ল, সম্প্রতি নালন্দায় নূতন করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী বিষয় আপনার?’
এবার যা বললেন, তাতে আকাশ থেকেই পড়লাম বটে। উত্তর দিলেন, ‘বৌদ্ধ বাদবিধি। আচার্য দিঙনাগ-রচিত ন্যায়শাস্ত্র।’
এসব আবার কেউ এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে বা পড়ায় নাকি? কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলাম।
কয়েকদিন পর বেড়াতে গিয়ে আবার ওই একই জায়গায় দেখা। হাঁটতে হাঁটতে টিলার উপর বসলাম দুজনে। সামনে খাদ। খাদের ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। সেই দিকে চেয়ে চেয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। আপনি?’
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘না। করি না। কিন্তু ট্র্যাজেডি হচ্ছে, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তাদেরকেও কালক্রমে কখনও কখনও মানুষ ঈশ্বর বানিয়ে তোলে। আমাকেও প্রায় ঈশ্বর বানিয়ে ফেলেছিল তিব্বতীরা।’
—বলেন কী? এখানে তিব্বত এল কোথা থেকে?
—এল না। আমিই গেলাম তো! আমার মাস্টারমশাই শান্তরক্ষিত তখন তিব্বতে মারা গেছেন। তাঁর পরে আমাকেই রাজা তিস্রোং দেউচান তিব্বতে নিয়ে গেলেন নালন্দা থেকে।
এই কথা শুনে আমার তো একগাল মাছি! এ লোক বলে কী? এ নিজেকে সেই অষ্টম শতকের বৌদ্ধ পণ্ডিত কমলশীল বলে ভাবে নাকি? আজব তো! মাথাটা দেখছি, একেবারেই গেছে। যাই হোক, খেলাটা আরও ভালো করে জমাবার জন্যে বললাম, ‘তা তিব্বতে গিয়ে কী দেখলেন, কমলবাবু?’
বিদ্রূপটুকু গায়ে না মেখে তিনি বলতে লাগলেন, ‘সে ভয়ংকর অবস্থা! তিব্বতী বন্ ধর্মকে ঠেকাতে রাজারা চিন থেকে, ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম আমদানি করেছেন। এদিকে সামেয়ি-বিহারে তখন ভারতীয় আর চিনা বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মধ্যে সদ্ধর্ম নিয়ে লড়াই বেঁধেছে। সেই তর্কযুদ্ধে আমি ভারতীয়দের পক্ষ নিলাম। বিপক্ষে চিনা পণ্ডিত হোসাঙ আর তাঁর দলবল!’
—তা তর্কের ফলাফল হল কী?
—আরে, আমার সঙ্গে চিনাগুলো পারবে কেন? তারা বলছে, নিশ্চেষ্ট হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাই ধর্ম। আমি বললাম, চরিত্র নির্মাণ করতে হবে, মনকে কুশল চিন্তায় কেন্দ্রিত করতে হবে। শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা। চলল তর্ক। শেষে চিনা হোসাঙ তো হেরে ভূত। তিব্বতীরা আমার জয়জয়কার করতে লাগল। আমাকে একেবারে দেবতা বানিয়ে ফেলল।
—বাহ, দারুণ তো!
—কীসের দারুণ? যে-লোক সারা জীবন ঈশ্বরকে অস্বীকার করে মানুষের অজেয় শক্তিকে সদর্পে প্রচার করে ফিরেছে, তাকেই কিনা দেবতা হয়ে উঠতে হল! তবে কিনা দেবতারও মৃত্যু আছে, বুঝলেন? হে হে!
—মানে?
—কিছুদিন পরেই হোসাঙের প্রেরিত আততায়ীদের হাতে আমি নৃশংসভাবে নিহত হলাম।
এইবার আর এই ইয়ার্কি সহ্য করতে না পেরে আমি বলে উঠলাম, ‘যাহ্! তাহলে আমার সঙ্গে কে এতক্ষণ কথা বলছে, কমলবাবু? কমলশীলের ভূত?’
তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কেন? একবার মৃত্যু হলে মানুষ কি আর জন্মায় না? আমিও জন্মালাম। বারোশো বছর পর। বর্ধমানের এক গণ্ডগ্রামে। অতি দরিদ্র পরিবারে।’
‘তা কী নাম হল আপনার এবার?’ আমার গলায় ব্যঙ্গবিদ্রূপের ঝাঁজ স্পষ্ট।
—একই নাম। কমল শীল। আমার বাবা ছিলেন ক্ষৌরকার।
—আরিব্বাস! তা সেখান থেকে...?
—পূর্বজন্মের সংস্কার। যুদ্ধ করার সংস্কার। অধ্যয়ন, অধ্যাপনার সংস্কার। সেসব যাবে কোথায়? প্রভূত জীবনসংগ্রাম করে কলকাতায় এলাম। ওই প্রেসিডেন্সিতেই ভর্তি হলাম। ফিলোজফি নিয়ে। ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষায় স্বর্ণপদক পেলাম। তারপর গবেষণা, অধ্যাপনা।
এবার ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল জলের মতো। লোকটির দর্শনশাস্ত্রে গভীর আগ্রহ। ওইসব পড়তে পড়তে নিজেকে দার্শনিক কমলশীলের ট্র্যাজেডির সঙ্গে একাত্ম করে তুলেছে। এতদূর একাত্ম যে, অবসেসড হয়ে গেছে। তার থেকেই এই উদ্ভুট্টি পাগলামি। ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিজর্ডার!
‘আপনার যা বয়েস, তাতে এখনই তো রিটায়ার করার কথা নয়। ভিআরএস নিয়েছেন নাকি?’
তিনি আবার জোরে শ্বাস ফেলে বললেন, ‘হ্যাঁ। ভিআরএস-ই নিলাম। পড়িয়ে কোনো লাভ নেই। কী অধ্যাপক, কী ছাত্র—আজকাল মৌলিক চিন্তা করার অভ্যাস কারোই নেই। সবাই নোট মুখস্থ করতে ব্যস্ত। বিরক্ত হয়ে ছেড়েই দিয়েছি পড়ানো।’
লোকটা পাগল, উল্টোপাল্টা বকে, কিন্তু মনে হল, লোকটি ভালো লোক। বিশেষত, পণ্ডিত। বললাম, ‘আমিও একটা উপন্যাস লিখেছি জানেন তখনকার তিব্বতের উপর?’
‘আপনার বইটার নাম শুনেছি। পড়া হয়নি।’
পরের দিন বইটা তাঁকে দিলাম। হপ্তাখানেক পরে ফেরত দিয়ে বললেন, ‘ভালই লিখেছেন। তবে কী জানেন? আপনার বড্ড গল্প বলার অভ্যাস। সর্বাস্তিবাদের আরেকটু গভীরে প্রবেশ করলেন না কেন? উপর-উপর হয়ে গেল যে!’
—বাবা! এর বেশি বললে লোকে বুঝবে?
—কেউ তো বুঝত! তবে আপনি ঠিকই বলেছেন। এখন সকলেই প্রায় পল্লবগ্রাহী। মানুষের ধৈর্য কম, মনোনিবেশ কম, হিংস্রতা প্রবল...সকলেই প্রায় ওই চিনা আততায়ীদের মতো...হন্তারক...জ্ঞানের ঘাতক...প্রেমের ঘাতক...
এই অন্ধকার মধ্যরাত্রে লুকোনো ডেরায় মলিন চাদরে মুখ-মাথা ঢেকে শুয়ে হঠাৎ মনে হল, আমি যে কমলবাবুকে পাগল ঠাউরেছি, সত্যিই যদি তা না হয়? সত্যিই যদি তিনি জাতিস্মর হয়ে থাকেন? তিনিই আগের জন্মে কমলশীল ছিলেন, যদি সত্যিই এমন হয়? এ জগতে কী সত্য আর কী মিথ্যা, কে বলবে?
দূরের মাঠ থেকে সহসা শেয়ালগুলো সমস্বরে ডেকে উঠল।
এই ধারাকাহিনির সব কটি লেখা একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে