লোহাঘাট যাবার বাস আরও তিন ঘণ্টা পর। বেলা দুপুর। রাস্তার ধারের ধাবাতে খেতে বসেছি। মোটা রুটি, সবজি, কাঁচা পেঁয়াজ আর আগুনঝাল পাহাড়ি লঙ্কা। জলের গ্লাসটা মুখে তুলতে গিয়ে চোখ পড়ল দূরের টেবিলটার দিকে। একা একজন বয়স্ক মানুষ খাচ্ছে। কানের নীচে নীলাভ একটা জড়ুল। খুব চেনা চেনা, অথচ স্মৃতি থেকে সঠিক পরিচয়টা ঠিক উঠে আসছে না। স্মৃতির আর দোষ কী? এত মুখ, এত ঘটনা বিচিত্র সব অনুষঙ্গে বাউন্ডুলের ভাণ্ডারে জমা পড়েছে, এখন আর সে একটা থেকে আরেকটার আঁশ সহজে ছাড়াতে পারে না।
আঁশটা ছাড়ানো গেল খাওয়ার পর রাস্তার ধারে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ধোঁয়া টানতে টানতে। মনে পড়েছে। সেই খয়েরি চোখ, ধারালো চিবুক, কোঁচকানো চুল আর নীলচে জড়ুল। চুলে অবশ্য এখন পাক ধরেছে, বয়সের ছাপ পড়েছে কপালে। তবু সেই একপাশে ঘাড় কাত করে রাখার ভঙ্গিমাটি পাল্টায়নি। ওহ, কতোদিন পর দেখলাম! কিন্তু কথা হচ্ছে, এ লোক এখানে কোন্ মন্ত্রবলে যে এল!
কলকাতার সাহিত্য উৎসব ও বকচ্ছপ বাংলা ভাষা
কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, লোকটা এদিকেই আসছে। আমাকে চিনতে পারার কোনো কারণ নেই তার। কাছে এসে এক বান্ডিল বিড়ি পকেট থেকে বের করে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘আপকা পাস আগ্ হ্যায়?’
ধীরে সুস্থে বিড়ি ধরিয়ে দেশলাই ফেরত দিল আমাকে। শূন্য চোখে পাহাড়ি রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে নীলচে ধোঁয়া ছাড়ছে। আমি একটু কেশে গলা সাফ করে জিগগেস করলাম, ‘আপনার নাম কি মনোতোষ গুছাইত?’
এই উত্তরাখণ্ডে বাংলা শুনতে পেয়ে লোকটা চমকে উঠল বোধহয়। তথাপি চমকানোর অনুমেয় হেতু, অপরিচিত লোকের মুখে নিজের নাম শুনতে পাওয়া। বিহ্বল দৃষ্টিতে লোকটা আমাকে দেখছিল আশিরনখর—কিছু মেলাতে চাইছে। কিন্তু পারল না। হাল ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কীভাবে আমাকে...?’
আমি বললাম, ‘আপনি কি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সাইকেল-খেলা দেখান?’
– ‘দেখাতাম। বছর পনেরো আগে। ছেড়ে দিয়েছি সেসব। আপনি আমাকে কোথায় দেখেছেন?’
– ‘গড়াইপুরে।’
– ‘...গড়াইপুর? ...কেশপুর? আমি তো নানান জায়গায় যেতাম সাইকেল নিয়ে। সে বহু বছর হল।’
অনেক বছর আগেই বটে। মনোতোষ গুছাইতের সাইকেল-খেলা দেখেছি যখন, তখন আমি বছর পনেরোর। পাশের গাঁয়ে ক্লাবের মাঠে মনোতোষ এসেছিল সাইকেল নিয়ে। সেই খেলা শুরু হবার আগে দিন পনেরো আশপাশের গাঁয়ে দু-বেলা মাইকিং চলছিল, “আনন্দ সংবাদ! আনন্দ সংবাদ! আগামী পয়লা অঘ্রাণ বিখ্যাত সাইক্লিস্ট মনোতোষ গুছাইতের আশ্চর্য সাইকেল-খেলা। তিনদিন সাইকেল থেকে মানুষ নামবে না। মাঠের মধ্যে সাইকেলের চাকা ঘুরবেই ঘুরবেই। সাইকেলেই আহার, বিহার, নিদ্রা। এই সাইকেল-চমক দেখতে চলে আসুন গড়াইপুর তরুণ সঙ্ঘের মাঠে। আগামী পয়লা অঘ্রাণ, রবিবার। এলাকার সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ। মনোতোষ গুছাইতের আশ্চর্য সাইকেল-খেলা...”
গল্প বলার অদলবদল
ওহ, কথাগুলো এতবার কানের কাছে বেজেছিল, আজও মনে আছে। আমিও গেছিলাম সুতির চাদর মুড়ি দিয়ে গড়াইপুর। ক্লাবের মাঠে বছর পঁয়ত্রিশের একজন মানুষ, কানের নীচে একটা নীলাভ জড়ুল, একটা হারকিউলিস সাইকেলে চেপে বৃত্তাকারে ঘুরছিল। তিনদিন সে সাইকেল থেকে নামবে না। শুধুই সাইকেল চালাবে, চালাবে, চালাবে। সকাল থেকে শুরু হয়েছে। দুপুরবেলা ক্লাবের ছেলেরা টিনের বালতিতে জল নিয়ে এল। সাইকেলে বসেই দাড়ি কামালো। মগে জল নিয়ে গায়ে ঢেলে স্নান করল। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলন্ত ব্যাগ থেকে প্রথমে গামছা বের করে গা-মাথা মুছল, তারপর সাইকেলে বসে বা দাঁড়িয়ে বিচিত্র কায়দায় ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে শুকনো জামাকাপড় পরল। আয়নায় মুখ দেখল। চুল আঁচড়াল। তারপর ক্লাবের ছেলেরা কানা-উঁচু থালায় ভাত-তরকারি এনে দিলে তাই খেল। সবই সাইকেলে বসে। একবারও মাটিতে পা ঠেকালো না।
আমি ভাবছিলাম, ছোটো বাইরে, বড় বাইরে যায় কীভাবে? একজন বলল, ওদিকে যে-ঝোপঝাড় আছে, প্রয়োজন পড়লে সাইকেলে চেপেই সেখানে যায়। সঙ্গে ক্লাবের ছেলেরা থাকে দেখবার জন্য যে, সে সাইকেল থেকে নামে কিনা। কিন্তু, না। মনোতোষ এসব জৈব প্রয়োজনেও মাটিতে পা নামায় না এই তিনদিন। যা হয়, সাইকেলে বসেই হয়। কাণ্ডই বটে। সাইকেলের উপরেই ঘুমোয়। আবার মাঝে মাঝে দেখলাম, সাইকেলটাকে কী কায়দায় জানি দাঁড় করিয়ে ব্যাগ থেকে বই টেনে নিয়ে একমনে পড়ছে। গ্রামের একটি ছেলে ফিসফিসিয়ে সসম্ভ্রমে বলল, ‘মনোতোষদা খুব পড়াশোনা করে।’
তবে সে বেশিরভাগ সময়েই সাইকেল চালায়। গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে। প্যাডেল ঠেলছে তো ঠেলছেই। কণ্ঠির হাড়, চোয়াল আর রগের কাছটা ভীষণ প্রতিজ্ঞায় শক্ত হয়ে আছে। তিনদিন সাইকেল থেকে নামবে না।
তিনদিন পর আরেক আশ্চর্য ঘটনা। বারো হাত মাটি খুঁড়ে সাইকেল সমেত মনোতোষকে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হল। মাটি চাপা দেওয়ার জায়গাটা সমান করে গোবর দিয়ে ন্যাতা দিয়ে দেওয়া হল। চব্বিশ ঘণ্টা পর নাকি মনোতোষকে তোলা হবে। গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা মাথা নেড়ে বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘এটা ঠিক হচ্ছে না। লোকটা বাঁচবে না। ক্লাবের ছেলেগুলো অলবড্ডে! কারুর কথা শোনে না। সবকটাকে খুনের দায়ে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।’
পরের দিন শুনলাম, আজ মনোতোষ উঠবে। আমি যথাসময়ে মহা কৌতূহল নিয়ে সেখানে হাজির। মাইকে মুকেশের গান করুণ সুরে বাজছে। শাবল, গাঁইতি দিয়ে ক্লাবের ছেলেরা মাটি সরাতে লাগল। আমি রুদ্ধশ্বাস আগ্রহে গর্তে উঁকি দিয়ে দেখলাম, সাইকেলটাকে চিত করে তার উপর মনোতোষ যেন ঘুমিয়ে আছে। গর্ত থেকে সাইকেল সমেত তাকে তোলা হল। গ্রামের ডাক্তার নিরঞ্জন চক্রবর্তী পরীক্ষা করে বললেন, ‘বেঁচে আছে। নাড়ি চলছে। তবে খুব ক্ষীণ।’ তারপর কীভাবে মনোতোষের জ্ঞান ফিরল, তার ডিটেইলস মনে নেই। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর গরম দুধটুধ খেয়ে মনোতোষ আবার সাইকেল চালাতে লাগল। জনতার সহর্ষ করতালির ভেতর মাইকে বেজে উঠল এবার কিশোরকুমারের দরাজ কণ্ঠস্বর, ‘হয়তো আমাকে কারো মনে নেই...’
“দাদুর প্রতি আমার অসীম প্রেম আছে”: রোদ্দূর রায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার
আমি উত্তরাখণ্ডের বাসরাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে মনোতোষকে দেখছিলাম। সেই মনোতোষ! কতো বুড়ো হয়ে গেছে, শরীর ভেঙে গেছে। চুল সাদা হয়ে গেছে অনেকটাই। বললাম, ‘এখন থাকেন কোথায়?’
– ‘বেলঘরিয়ায়’
– ‘আপনার সম্বন্ধে তো কিছুই জানি না। বেলঘরিয়ারই লোক?’
– ‘নাহ, আদিবাড়ি পাঁশকুড়ায়। ছোটোকালে বাপ-মা মরে যায়। কাকা মানুষ করেছিল। মানুষ বলতে ওই বি এ পাশ আরকি। চাকরিবাকরি পাইনি। তখন ওই সাইকেল-খেলা দেখাতাম গ্রামে গ্রামে। তাই থেকেই যা-কিছু ইনকাম।’
– ‘সংসারাদি করেননি?’
– ‘নাহ, সংসার আর হল কই?’ মনোতোষ একটু কাশল। তারপর সসংকোচে জিগগেস করল, ‘তা আ-আপনি? আপনি যাবেন কোথায়?’
আমি বললাম, ‘দেখছেনই তো আমাকে...চালচুলোহীন ভবঘুরে জীবন...আপাতত, আলমোড়া যাচ্ছি।’
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। মনের ভেতর আমার একটা কৌতূহলের কাঁটা খচখচ করছিল। ভাবছিলাম, জিগগেস করব কিনা। তারপর ভাবলাম, বলেই ফেলি। শুধালাম, ‘প্রভাতীকে মনে আছে আপনার? গড়াইপুরের প্রভাতী মণ্ডল?’
মনোতোষ বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ল। হাসল। স্মৃতিবিষাদের হাসি। তারপর বলল, ‘তা মনে আছে।’
– ‘আপনাদের যোগাযোগ হল কীভাবে? আপনি তো সবসময়েই ওই তিনদিন সাইকেলে। তারপর চলে গেলেন।’
মনোতোষ কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্মৃতিঘোর ভেঙে যেন জেগে উঠে বলল দূরাগত স্বরে, ‘প্রভাতী রোজ খেলা দেখতে আসত। ভিড়ের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। আমি খেয়াল করিনি। গড়াইপুর থেকে চলে আসার মাস দেড়েক পর প্রথম আমাকে চিঠি লেখে। তারপর আমরা দুজন নাড়াজোলের মেলায় প্রথম দেখা করি।’
– ‘হ্যাঁ, গড়াইপুরে খুব কথাবার্তা ছড়াচ্ছিল...’
– ‘ছড়ানোই স্বাভাবিক। প্রভাতী খুব জেদি মেয়ে। আমরা এখানে ওখানে প্রতি মাসেই দেখা করতাম। হলদিয়া বেড়াতে গিয়েছিলাম একদিন দুপুরে। এইসব নিয়েই কথা, অকথা... তারপর আমি দু-বছর বাদে প্রভাতীর বাবার সঙ্গে দেখা করতে গড়াইপুর গেছিলাম। প্রভাতীর বাবা রাগে অগ্নিশর্মা, আমাকে এই মারে তো সেই মারে...বলল—আমার চাকরিবাকরি নেই, এইসব ছোটোলোকি খেলা দেখাই, লজ্জা করে না? আমাকে মেয়ে দেবে না। প্রভাতীকে ঘরে শিকল তুলে আটকে রাখল। আমি ফিরে এলাম।’
– ‘প্রভাতীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি, না?’
– ‘হয়েছিল বছর দশেক পর। মেচেদা স্টেশনে। প্রভাতী, প্রভাতীর বর, একটি খোকা। বরের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর বরের কোলে বাচ্চাটাকে দিয়ে বলল, বাবার কোলে বসে থাকো তো, সোনা! আমি এই মামাটাকে নিয়ে একখুনি তোমার জন্যে চকো কিনে আনছি। দুষ্টু করবে না।’
– ‘প্রভাতী বলল আড়ালে নিয়ে গিয়ে আপনাকে?’
– ‘বলবে আর কী! স্টেশনের ওধারে নিয়ে গিয়ে বলল, এবারে তো আর হল না, মনোতোষদা! এ জন্মে অন্য মানুষেরই ঘর করলাম। তুমি আর এভাবে বসে থেকো না। বিয়েশাদি করো। তোমাকে এভাবে দেখতে পারছি না।’
– ‘চোখের আড়ালেই তো আছেন আপনি। দেখতে তো হচ্ছে না প্রভাতীকে...’
– ‘আমি কিছু বলিনি। কী আর বলব? সে হয় নাকি? প্রভাতীর তো কিছু করার ছিল না। তবু ওই প্রভাতীকেই...যা হোক...’
– ‘প্রভাতীর দাগ বুকের মধ্যে নিয়ে সারাজীবন...?’
– ‘ধুর, তা হয় নাকি? বছর পাঁচ পর প্রভাতীর কথা ফিকে হয়ে এল। খাওয়াপরার চিন্তা আছে না? তবে বিয়েটিয়ে আর করিনি। নিজেরই পেট চলে না, তার আবার বিয়ে!’
– ‘সাইকেল-খেলা ছাড়লেন কেন?’
– ‘আর পা চলে না। তাছাড়া ওই গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে...ভালো লাগে, বলুন? শেষের দিকে মনে হত সোজা চালিয়ে দিই শালা সাইকেলটা চক্কর ভেঙে। পালিয়ে যাই। শেষে ছেড়েই দিলাম।’
– ‘পাঁশকুড়ায় এসে বসলেন।’
‘আরেহ না! ওই বাড়ির অংশ বেচেই তো এলাম কলকাতায়। বেলঘরিয়ায় ঘর ভাড়া নিলাম। ব্যাঙ্কে অল্প কিছু ফিক্সড করতে পেরেছি। তারই সুদ থেকে... আর ওই জমি, বাড়ি, জায়গার দালালি করে টু-পাইস। চলে যাচ্ছে তা বেশ আনন্দেই। একা থাকি। দুটি ফুটিয়ে খাই। দিব্বি আছি, ঝাড়া হাত পা। অনেকদিন কোথাও যাইনি কলকাতা ছেড়ে। হঠাৎ হাতে কিছু ফালতু টাকা এল। তা ভাবছি একটু ঘুরে...’
লোকটার মুখ দেখে মনে হল, কথাটা বানিয়ে বলছে না অভিমানবশত। অভিমান ধরে রাখতে দেয় না বরিষ্ঠ জীবন। সোজা চালিয়ে দেয় চক্কর ভেঙে।
ধুলামাটির বাউল সিরিজের সব লেখা একত্রে পড়ুন এই লিংকে