ভারতের হয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ হয় উত্তর ২৪ পরগণার অরিন্দমের। ভারতের সঙ্গে প্রথম খেলা পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার। এইটুকু পড়ে নিশ্চয় খটকা লাগলো! ভারত ফুটবল বিশ্বকাপে তো এখনও অংশগ্রহণই করতে পারলো না। তবে এই বাংলার খেলোয়াড় কী করে বিশ্বকাপ খেলল? এরকম প্রশ্ন মনে আসাটাই স্বাভাবিক। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও বাস্তবে এমনটাই হয়েছে। আপনি অরিন্দমের অটোতে বসেই হয়তো কোন না কোন সময় যাতায়াত করেছেন। আর আপনি জানতেই পারলেন না অটোর ড্রাইভার ছেলেটায় ভারতের জাতীয় ফুটবল দলের একসময়ের গোলরক্ষক!
কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গিয়েছে। ফুটবল জ্বরে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন পুরো দেশ। এমন সময়ে ভারতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় অটো ড্রাইভার! আপনাদের নিশ্চয় সব বড্ড গোলমেলে লাগছে! তবে খোলসা করেই বলা যাক। সেবার আয়োজিত গৃহহীনদের (Homeless World Cup) বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসে ব্রাজিলে। অরিন্দমের কাঁধেই ছিল তিনকাঠি সামলানোর দায়িত্ব। সালটা ২০১০। খেলা হয়েছিল ফুটবলের স্বর্গরাজ্যে ব্রাজিলে। নানান দেশের খেলোয়াড়দের পায়ে দ্রুত গতিতে ছুটে আসা বল সামলেছিলেন অরিন্দম। তারপর কেটে গেছে ১২টি বছর। আজ অবশ্য সবটাই অতীত।
এ সব স্বপ্নের মতন মনে হয় এখন অরিন্দমের। পুরো নাম অরিন্দম ঘোষাল। মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা। বাংলা থেকে অরিন্দমই একমাত্র সুযোগ পেয়েছিলেন বিশ্বকাপ খেলার। আর সেখানে তাঁকে দেখা গিয়েছিল গোলরক্ষকের ভূমিকায়। ব্রাজিল থেকে খেলে আসার পর তার বাড়ির সামনে ভিড় জমাতেন অনেকেই। সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে একই মঞ্চে পেয়েছেন সংবর্ধনাও। সোনালি দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখন চোখে জল আসে।
জাতীয় দলের প্রাক্তন এই গোলরক্ষকের পেট রক্ষা করতে হয় অটো চালিয়ে। প্রতিভাবান এই খেলোয়াড়ের তীব্র অর্থ কষ্ট নিয়ে চলছে জীবন সংগ্রাম। দু’বেলার খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়। শত কষ্টের মাঝেও এখনও সময় বের করে চালিয়ে যাচ্ছেন খেলা। কারণ ফুটবলই যে তার ভালোবাসা, বাঁচার অনুপ্রেরণা।
অটোয় সব প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দেওয়ার পর, অরিন্দম বলেন, "ভারতীয় দলের হয়ে খেলে আসার পরেও কোন চাকরি পায়নি, মধ্যমগ্রামের বিধায়ক তথা রাজ্যের বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষের সাহায্যে একটি রুটে অটো চালাতে শুরু ব্যাস তারপর থেকে সকালে অটো চালায় বিকেলে যতটুকু সময় পাওয়া যায় ফুটবল প্র্যাকটিস করি। আমার মতন কত হাজার হাজার খেলোয়াড় আছে এই দেশে, যারা অভাবের কারণে খেলা ছেড়ে দিয়েছে। বিদেশের খেলোয়াড়দের দেখেছি কত উন্নত মানের পরিকাঠামো। আমাদের কিছুই নেই খাবারটুকু পর্যন্ত ঠিক মতন জোটেনা"
শুধু জাতীয় দল নয় ইস্টবেঙ্গল জুনিয়র, এফসিআই, রাজস্থানের মত দলেও খেলেছেন অরিন্দম। স্বপ্নভঙ্গ হয় ২০১২ সালে। খেলতে গিয়ে গুরুতর চোট পান পা-তে। ডান পায়ের মালায়চাকি ভেঙ্গে তিন টুকরো হয়ে যায়। তারপর সেই পা অপারেশন হয়। দীর্ঘ আটমাস চলা ফেরার ক্ষমতায় ছিল না। সেই ধাক্কা কাটিয়ে তিনি মাঠে ফেরেন। তবে মাঠে ফিরলেও আগের মতো মনোবল আর নেই তাঁর। মানসিক শক্তি হারিয়েছেন অনেকটাই। আক্ষেপ একবারের জন্যেও কেউ খোঁজ নিতে আসেনি।
ফুটবলই তার একমাত্র ভালোবাসা। কষ্টের মাঝেও একে ফুটবল ছেড়ে বেশি দিন থাকতে পারেননি। আক্ষেপ করেই অরিন্দম বলেন," পায়ে চোট লাগার পর সবার উপর অভিমান হয়েছিল ভেবেছিলাম আর ফুটবল খেলবো না। ভারতীয় দলের জার্সি, বুট সব লোককে দিয়ে দিয়েছি। এখন আমার কাছে আছে শুধু ভিসার কাগজ আর ব্রাজিল থেকে পাওয়া সার্টিফিকেট।"
অটো চালানোর পাশাপাশি উপরি রোজগারের জন্যে লোকাল ফুটবল ম্যাচ খেলতে হয়। মনোবল ভেঙ্গে গেলেও ফুটবলটাকে আঁকড়ে ধরে আছেন। ফুটবলই তাঁর প্রথম প্রেম। অরিন্দমের একটা চাকরি পেলে হয়তো বেঁচে থাকার লড়াইটা খানিক সহজ হত। যদিও তাঁকে সাহায্যে করার মতন এমন কেউ নেই। যার কাছে তিনি আবেদন করতে পারবেন। এরকম কত শত খেলোয়াড় হারিয়ে যাচ্ছে তার খোঁজ কেউ রাখে না।