আবাস যোজনা নিয়ে এবার বড়সড় দুর্নীতি ফাঁস পূর্ব বর্ধমানে। জামালপুরের এই ঘটনায় কাঠগড়ায় স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। স্থানীয় পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধেও দুর্নীতিতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকার অভিযোগ বিজেপির।
আবাস যোজনা দুর্নীতি-কাণ্ডে বড়সড় ফাঁপড়ে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব ও পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ। পূর্ব বর্ধমানের জমালপুরের কাঠুরিয়া পাড়া গ্রামে থাকা নীল-সাদা রঙের তৃণমূলের 'উন্নয়ন ভবনটি' তৈরি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পেই। কিন্তু ওই বাড়িটির জমি উপভোক্তা শঙ্কর মাঝির নামে না থাকলেও সেখানেই 'জিও ট্যাগিং' করা হয়েছিল। আবার একই উপভোক্তার নামে এলাকায় সেচ দফতরের বাঁধের জায়গাতেও একটি বাড়ি রয়েছে। সেই বাড়ির দেওয়ালেও লেখা রয়েছে 'বাংলা আবাস যোজনা' এবং একই উপভোক্তার নাম।
অভিযোগ মিলতেই শুরু হয় তদন্ত। ব্লক প্রশাসনের কর্তারা একপ্রকার 'নিশ্চিত' যে, সরকারি অনুদানে তৈরি বাড়ি নিয়ে বেআইনি কাজ হয়েছে। এদিকে, আবাস যোজনার এই দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসতেই শাসকদল তৃণমূলকে কাঠগড়ায় তুলে সোচ্চার হয়েছে বিরোধীরা। প্রশাসন পদক্ষেপ না করলে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি বিরোধীদের।
জামালপুর ২ পঞ্চায়েত অফিসের কাছেই রয়েছে কাঠুরিয়াপাড়া গ্রাম। শঙ্কর মাঝি ও তাঁর পরিবার এই গ্রামেরই বাসিন্দা। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে শঙ্কর মাঝির নামে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর অনুমোদন হয়। যার আইডি নম্বর পিএমএওয়াই - ডব্লিউবি ১৬৮৫৩৩২। ঘর তৈরির জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা উপভোক্তা শঙ্কর মাঝির নামে বরাদ্দ হয়। সেই টাকায় পাকা বাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর নিয়ম মেনে তার 'জিও ট্যাগিং' হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও ওই বাড়িতে শঙ্কর মাঝি বা তাঁর পরিবারের কারও ঠাঁই হয়নি। সেটি হয়ে যায় তৃণমূল কংগ্রেসের বিলাসবহুল 'উন্নয়ন ভবন'। জেলা ও ব্লক তৃণমূলের এক ঝাঁক নেতা-নেত্রী মিলে ওই পার্টি অফিসের উদ্বোধন করেছিলেন। 'উন্নয়ন ভবন'-এর ভিতরে রয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর ছবি। এছাড়াও রয়েছে এলইডি টিভি ও দামী আসবাবপত্র।
আবাস যোজনার বাড়িতে তৃণমূলের কার্যালয় তৈরির খবর ছড়িয়ে পড়তেই ময়দানে নামে বিজেপি। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বিজেপি যুব মোর্চার কর্মীরা আন্দোলনে নামেন। তখন চাপে পড়ে গিয়ে ব্লকের ওই তৃণমূলের নেতারা এবং জামালপুর ২ পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ ভোল বদল করে। পার্টি অফিসটি ছেড়ে দেওয়া হয় উপভোক্তা শঙ্কর মাঝিকে। পঞ্চায়েত প্রধান মণিকা মুর্মু ও উপ-প্রধান উদয় দাস ঘরের চাবি তুলে দেন শঙ্কর মাঝির হাতে। এমনকী তৃণমূলের 'উন্নয়ন ভবন'টি যে আসলে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকায় তৈরি উপভোক্তা শঙ্কর মাঝির বাড়ি সেকথাও পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ ওই উন্নয়ন ভবনের দেওয়ালে লিখে দেন। তার পর অবশ্য আন্দোলন থেমে যায়। এপরপরেই উপভোক্তা শঙ্কর মাঝিকে
'উন্নয়ন ভবন' থেকে বের করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন- বঙ্গ সফরে মন নেই মোদী-শাহ-নাড্ডাদের? হঠাৎ স্থগিত তিন নেতার কর্মসূচি
'উন্নয়ন ভবন'-এর দেওয়ালে লেখা আবাস যোজনা সংক্রান্ত তথ্যও মুছে দেওয়া হয়। তার পর শঙ্কর মাঝি ও তাঁর পরিবারের ঠাঁই হয় গ্রাম থেকে খানিকটা দূরে সেচ দফতরের বাঁধের জায়গায়। এর কারণ জানতে চাওয়া হলে তৃণমূল নেতা রামরঞ্জন সাঁতরা গোটা ঘটনার জন্য জামালপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করেন। পাশাপাশি তিনি এও জানান, ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি শঙ্কর মাঝির জন্য সেচ দফতরের বাঁধের জায়গায় ইটের দেওয়াল আর অ্যাসবেসটসের ছাউনির বাড়ি তৈরি করে দেন। লেখক দিয়ে ওই বাড়ির দেওয়ালে তিনিই শঙ্কর মাঝির প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ি পাওয়া সংক্রান্ত তথ্য ও আই-ডি নম্বরও লিখে দিয়েছেন বলেও জানান। একইসঙ্গে রামরঞ্জন সাঁতরা এও দাবি করেন 'উন্নয়ন ভবন'-এর জায়গার সঙ্গে শঙ্কর মাঝির সরকারি আবাস যোজনার বাড়ি কোনও সম্পর্ক নেই।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে শঙ্কর মাঝির আবাস যোজনার বাড়ি নিয়ে সম্প্রতি নতুন করে বিতর্ক তৈরি হতেই তদন্তে নামে জামালপুর ব্লক প্রশাসন। সেই তদন্তের রিপোর্টে মেনে নেওয়া হয়েছে, যে শঙ্কর মাঝির আবাস যোজনার বাড়ি নিয়ে পরপর দু’টি ‘ভুল’ হয়েছে। রিপোর্টে এও বলা হয়েছে, খাঁপুর মৌজায় নির্মীয়মাণ বাড়িটিকেই প্রয়াত উপভোক্তা শঙ্কর মাঝির বলে দেখানো হয়েছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থ বর্ষে বাড়ি তৈরির জন্যে তিনটি কিস্তিতে শঙ্কর টাকায় তুলে নিয়েছিলেন।
চূড়ান্ত পর্যায়ে সেখানেই তার ‘জিও ট্যাগিং’ও করা হয়েছিল। সেই কারণে নীল-সাদা রঙের বাড়িটি প্রশাসনের খাতায় শঙ্কর মাঝির বলেই উল্লিখিত রয়েছে। ওই বাড়ির গায়ে ‘বাংলা আবাস যোজনা’ লিখেছিল স্থানীয় পঞ্চায়েত। যদিও যে জমিতে সরকারি আবাস যোজনার বাড়িটি তৈরি হয় সেই জায়গাটি আদতে শঙ্কর মাঝিরই নয়। ফলে ওই জায়গায় আবাস প্রকল্পের বাড়ি হলেও তা ‘বেআইনি’ ভাবেই হয়েছে।
আরও পড়ুন- শুভেন্দুর সভায় সরকারি আবাস যোজনার ফর্ম জমা, বিতর্ক তুঙ্গে
এই রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রশ্ন উঠেছে, উপভোক্তার নামে আবাস যোজনার রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাওয়া ও তার পর তিন কিস্তির সরকারি টাকা তুলে নেওয়ার পর বাড়িটা তৈরি হল কোথায়? দামোদরের ধারে সেচ দফতরের বাঁধের জায়গায় তো সরকারি আবাস যোজনার বাড়ি তৈরি করা যায় না। নিজস্ব জমি দেখাতে না পারলে কেউ তো প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার উপভোক্তা হিসেবে বাড়িও পেতে পারেন না।
তাহলে সরকারি টাকা তুলে নেওয়া হলেও সরকারি আবাস যোজনার বাড়ি কি আদৌ তৈরি হয়নি? পুরো টাকাটাই কি কেউ আত্মসাৎ করে নিয়েছে? এই প্রশ্নই এখন রাজনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান উদয় দাসের দাবি, “পঞ্চায়েতের খাতাতে নীল-সাদা রঙের বাড়িটি শঙ্কর মাঝির বলেই ওই বাড়ির দেওয়ালে তা উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছিল’। জামালপুরের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার বলেন, “প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্ট জেলায় জমা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন যা নির্দেশ দেবে সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
আরও পড়ুন- এবার জেলেই পেটপুজো, আমিষ-নিরামিষের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উদরপূর্তির লোভে ৮ থেকে ৮০
এদিকে, উপভোক্তা শঙ্কর মাঝির নাতনি পূজা মাঝি সব শুনে মঙ্গলবার দাবি করেন, কাঠুরিয়াপাড়া গ্রামের বাড়িটা তাঁর দাদুর না হলে তাহলে কে দাদুকে ওই বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলেছিলেন? কেনই বা ওই বাড়িটার দেওালে ‘বাংলা আবাস যোজনা’ লিখে পঞ্চায়েত তাঁর দাদুর নাম লিখে দিয়েছিল। পরে আবার কেন ওই বাড়ির বদলে দামোদরের বাঁধের জায়গায় বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হল?”
বিজেপির যুব মোর্চার জামালপুরের আহ্বায়ক অজয় ডোকাল বলেন, “প্রকৃত উপভোক্তার ঘাড়ে বন্দুক রেখে তৃণমূল সরকারি প্রকল্পের টাকা লুঠ করেছে। তৃণমূলকে বাঁচাতে এই আসল সত্য আড়াল করেছে প্রশাসন। মনগড়া একটা রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।” তবে ব্লক তৃণমূলের সভাপতি মেহমুদ খান জানিয়েছেন, তদন্তের রিপোর্টে কেউ দোষী হলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।