ভূমধ্যসাগরীয় ঝড় ড্যানিয়েলের জেরে উপচে আসা বন্যার জল ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ থেকে দৃশ্যমান। (AP)
ঝড়ে লিবিয়ায় কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ আরও কয়েক হাজার। বছরের পর বছর বিশৃঙ্খলা এবং বিভাজনের রাজনীতিতে লিবিয়া প্রায় ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে এই ঝড়। এমনিতে লিবিয়ায় বন্যা সবচেয়ে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়। সঙ্গে, বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধ সেদেশের আর্থিক মেরুদণ্ডকে একপ্রকার ভেঙে দিয়েছে। কোনও স্থায়ী কেন্দ্রীয় সরকার নেই। তার মধ্যেই পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার মত ভয়াবহ ঘটনা। রাষ্ট্রসংঘের মতে, বর্তমানে লিবিয়াই একমাত্র দেশ, যারা জলবায়ুগত পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনও স্থায়ী কৌশল তৈরি করতে পারেনি।
Advertisment
২০১১ সালে ন্যাটো-সমর্থিত বিদ্রোহে স্বৈরাচারী শাসক মোয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকে উত্তর আফ্রিকার দেশটি বিদ্রোহী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রশাসনের মধ্যে বিভক্ত। যার জেরে সংঘর্ষ এখানে লেগেই থাকে। দেশটির পূর্বের দেরনা শহরটি সবচেয়ে বেশি ধ্বংস দেখেছে। সেখানে দুটি বাঁধ ফেটে নদী তীরের বড় ভবনগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঘটনার ভিডিও দেখায় যে বন্দর শহরের অবশিষ্ট টাওয়ার এবং উলটে যাওয়া গাড়িগুলোর মধ্যে দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। জল একটু সরার পর কম্বল দিয়ে আচ্ছাদিত ফুটপাতে সারিবদ্ধ লাশগুলো কবর দেওয়ার জন্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। বাসিন্দারা বলছেন যে বিপদের একমাত্র ইঙ্গিত ছিল বাঁধ ভাঙার জোরে শব্দ। বাসিন্দাদের ক্ষোভের কারণ, প্রশাসন কোনও সতর্কতা ব্যবস্থা বা বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাই গ্রহণ করেনি।
Advertisment
লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দ্বেইবাহ (টুইটার/@কুদসনেন)
তার কারণ হিসেবে বাসিন্দারা এদেশের দুই সরকার, দুই প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করছেন। ২০১৪ সাল থেকে লিবিয়ায় দুই সরকার এবং দুই প্রধানমন্ত্রী। লিবিয়া দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। আর, প্রতিটি সরকারই আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক এবং সেদেশের মাটিতে অসংখ্য সশস্ত্র জঙ্গিদের দ্বারা সমর্থিত। ত্রিপোলিতে প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দ্বেইবাহ লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের প্রধান। বেনগাজিতে আবার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানমন্ত্রী ওসামা হামাদ, পূর্বতন প্রশাসনের প্রধান। শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠনের কমান্ডার খলিফা হিফতার সমর্থন রয়েছে তাঁর পিছনে।
লিবিয়ার শাহহাট শহরে একটি শক্তিশালী ঝড় এবং ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে এলাকা জুড়ে বন্যার জলের বায়বীয় দৃশ্য। (রয়টার্স)
উভয় সরকার এবং খলিফা হিফতার বন্যা কবলিত এলাকায় উদ্ধারে যাবতীয় সাহায্য করার জন্য আলাদাভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও, তেমন কোনও সাহায্যের নমুনা দেখা যায়নি। সরকারের মতই লিবিয়ায় এখন একাধিক পার্লামেন্টও তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপও যাকে একটি পার্লামেন্টে বদলাতে পারেনি। এমনকী, ২০২১ সালে নির্বাচনের কথা থাকলেও লিবিয়ায় সেই নির্বাচন হয়নি। ২০২০ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। রাজধানী ত্রিপোলি দখলের চেষ্টায় এক বছর ধরে যুদ্ধ চলে। দখল করতে ব্যর্থ হয়ে হিফটারের বাহিনী ত্রিপোলি অবরোধ করে। কয়েক হাজার মানুষ নিহত হন। তারপরে ২০২২ সালে, প্রাক্তন নেতা ফাথি বাসাগাহ ত্রিপোলিতে তাঁর সরকার চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, প্রতিদ্বন্দ্বী জঙ্গিদের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে তাঁকে সেই পরিকল্পনা প্রত্যাহার করতে হয়।
স্যাটেলাইট ফটোগুলির একটি সংমিশ্রণ চিত্র লিবিয়ায় শক্তিশালী ঝড় আঘাত হানার আগে এবং পরে একটি এলাকা দেখায়। (সূত্র: রয়টার্স)
আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন লিবিয়ার বিভাজনকে আরও চওড়া করেছে। হিফটার বাহিনীকে মিশর, রাশিয়া, জর্ডন এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি সমর্থন করেছে। আর, পশ্চিম লিবিয়া প্রশাসনকে তুরস্ক, কাতার এবং ইতালি সমর্থন করেছে। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, মিশর এবং তুরস্ক লিবিয়ার মাটিতে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। কিন্তু, মঙ্গলবার পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান দেরনায় পৌঁছতে হিমশিম খাচ্ছিল। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একজন প্রবীণ লিবিয়া বিশ্লেষক ক্লডিয়া গাজিনি বলেছেন যে উদ্ধারকাজে সমস্যার কারণ, বন্দর শহর দেরনায় প্রবেশের অনেক রাস্তা ঝড়ের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও একটা বড় কারণ।