কামেরের ইংরেজি বানানটা থমকে দেওয়ার মত, কে এ এম ই আর এ ওয়াই। অর্থাৎ, ক্যামেরা বললেও হত। যদি সেখান পৌঁছে যান কখনও, তাহলে নিশ্চিত বুঝবেন, ভুলই ছিল। তবে সম্পূর্ণ নয়। এ জায়গাটা ক্যামেরা নয়, ফোটোগ্রাফ।
প্রথমেই ভৌগোলিক ব্যাপারটা স্বল্পে সেরে নেওয়া যাক। কামেরে পূর্ব সিকিমে অবস্থিত একটি গ্রাম, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১৫০০ ফিটের একটু বেশি। কামেরের সৌন্দর্য্য নিয়ে বেশি কথা খরচ করার মত নয়। কিন্তু যা নিয়ে কথা খরচ করা যায়, তা হল, এ গ্রামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য - যা সামাজিক, প্রাকৃতিক নয়। যা কামেরেকে ভিন্ন অর্থে সুন্দর করে তোলে।
চাষ এ গাঁয়ের মানুষের মূল জীবিকা। সারা ভারতের অন্য অনেক গাঁয়ের মতোই। তবে এখানে কৃষিকাজ বলতে জৈব চাষ। এক এবং একমাত্র। এবং সারা কামেরের প্রতিটি পরিবার চাষই করে। সে চাষ হয়ে থাকে জৈব পদ্ধতিতে।
আমরা শুরুতে অতিথি হয়েছিলাম গ্রামপ্রধান সিপি ভট্টরাইয়ের বাড়িতে। গ্রাম প্রধান বলতে যে ছবিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে এক্কেবারে মেলাতে পারবেন না সিপি-কে। অতি তরুণ, কিঞ্চিৎ লাজুক, সিপি ভট্টরাইয়ের বাড়িতে কৃষিকাজ বলতে সুসংহত জৈবচাষ।
সুসংহত জৈবচাষ বলতে কী বোঝায়? সিকিম সরকারের কৃষিবিভাগের আধিকারিক, যিনি সিপি ভট্টরাইয়ের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন বিশেষ উপলক্ষের দিনটিতে, জানালেন, "এখানে কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় সবুজ সারটুকুও তৈরি করে নেওয়া হয় নিজেদের হাতে করেই। সে পোকা মারা সার, কিংবা ফলন বৃদ্ধির সার, যাই হোক না কেন।"
এ গ্রামে কৃষির সঙ্গে রয়েছে গোপালনের মাধ্যমে আয়ের বন্দোবস্তও। গরুর দুধের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য যে আজোলার ব্যবহার হয়ে থাকে, সেই আজোলার চাষও করে থাকেন সিপি ভট্টরাই। এত কিছু কীভাবে করা সম্ভব হচ্ছে?
এর সবচেয়ে বড় কারণ যদি আগ্রহ, উৎসাহ ও সচেতনতা হয়ে থাকে, তবে অনস্বীকার্য যে এসবকেই বাড়তি রসদ জোগাচ্ছে সিকিম সরকার। অর্গানিক সিকিম, ওঁরা এভাবেই বর্ণনা করে থাকেন। ওঁরা মানে সিকিমের মানুষ। ২০১৬ সাল থেকে সিকিম রাজ্য সম্পূর্ণত অর্গানিক চাষের রাজ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। এমন রাজ্য গোটা দেশে আর একটিও নেই।
এঁদের সমস্ত রকম সহায়তা দিয়ে থাকে আত্মা অর্থাৎ Agriculture Technology Management Agency (ATMA)। আত্মার এ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক বীণা রাই জানালেন, সিপি ভট্টরাইদের উৎসাহ দেখে তাঁরা নিজেরাও উৎসাহিত হয়েছেন গোটা প্রকল্পে। আত্মার পক্ষ থেকে কৃষি বিভাগের সঙ্গে কৃষকদের মধ্যে সংযোগসাধনের চেষ্টা করা হয়, যাতে কৃষি দফতরের তরফ থেকে যে প্রকল্পগুলি দেওয়া হচ্ছে তার সুবিধে ভোগ করতে পারেন এই কৃষকরা। তবে তাঁদের প্রধান কাজ প্রশিক্ষণ। যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কামেরে বা কামেরের মত গ্রামগুলির কৃষকরা সমস্ত রকম সহায়তা পেয়ে থাকেন। কামেরে গ্রাম বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই নজরে ছিল সিকিমের কৃষি ও উদ্যানপালন দফতরের। তাঁদের মনে হয়েছিল এ গ্রামের কৃষকরা অন্য কৃষকদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছেন চিন্তা ভাবনায় এবং কাজের দিক থেকে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে দফতর দেখেছিল, তাঁদের গ্রহণক্ষমতাও খুব ভাল। ফলে এগোতে সমস্যা হয়নি কামেরের।
আত্মার এক আধিকারিকের কথায়, এঁদের সুসংহত প্রকল্পের সুবিধা এই যে, এঁদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। যদি কোনও বছর চাষ মার খায়, তাহলে রইল গোপালন অথবা মৌমাছি পালন। রয়েছে উদ্যান প্রকল্পও।
উদ্যান প্রকল্পের কাজ চালান মণি ছেত্রী। তাঁর গ্রিনহাউসে চাষ হয় অর্কিডের। আর তার বাইরে বেরোলেই দেখবেন লঙ্কা, ব্রকোলি, টোম্যাটো। গত বছর হলুদ চাষ করেছিলেন। সামান্য জায়গায় চাষ করা সত্ত্বেও সে হলুদের ফলন ভালোই হয়েছিল। বিক্রি করেছিলেন ১১ কিলোমিটার দূরের রংপো বাজারে। এ বছর অবশ্য রংপো নয়, তাঁর হলুদ পৌঁছবে ভিন দেশে। রফতানির ব্যাপারে সমস্ত কথা পাকা হয়ে গেছে।
ভিন দেশে রফতানির যোগাযোগগুলি কী ভাবে এল? এ প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হবে ২০১৭ সালে। জৈবচাষে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৭ সালে ওয়ানওয়ার্লড পুরস্কার পেয়েছিলেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং। ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে সে পুরস্কার কমিটির জুরি এবং বিশিষ্ট পরিবেশবিদ বন্দনা শিবা বলেছিলেন, "টানা পাঁচ বছর ধরে নিজের কঠোর পরিশ্রমের জন্য মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আসা একমাত্র রাজনীতিবিদের নাম পবন চামলিং।"
পবন চামলিংয়ের জৈবকৃষিতে সারা রাজ্যকে উদ্যোগী করে তোলার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল সেই ২০০৩ সালে। ওয়ানওয়ার্লড পুরস্কারদাতা দেশ জার্মানির সঙ্গে ২০১৭ সালেই যোগাযোগ গভীরতর হয় দেশের উত্তরপূর্বের এই ছোট রাজ্যটির। সে উপলক্ষে জৈবকৃষিতে সবরকম সাহায্য দিয়ে থাকেন জার্মানির নাগরিকদের একটা অংশ। তাঁরাও হাজির ছিলেন কামেরের মৌমাছি প্রতিপালন কেন্দ্রে, এবং গ্রামপ্রধান সিপি ভট্টরাইয়ের বাড়িতে।
কিন্তু তার আগে, আগের গল্প।
২
সালামথাংয়ের হোম স্টে-তে বসে কথা হচ্ছিল অমৃতের সঙ্গে। অমৃত এক সময়ে ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। শিলিগুড়িতে পোস্টিং ছিল তাঁর। সিকিমের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শিলিগুড়ির পরিবেশ, সকাল সাড়ে নটার অফিস, এসবে মন লাগছিল না। তিনি ফিরে আসেন সালামথাংয়ে, তাঁর নিজের বাড়িতে। প্রথমে নিজের বাড়ির দুটো ঘরে হোমস্টে শুরু করেন। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সালামথাংয়ের নিজস্ব সৌন্দর্য তো রয়েইছে, তারপর রয়েছে তাঁর বাড়ির ভিউ পয়েন্ট। সদা সেখানে অতিথিসমাগম।
কিন্তু এটুকুতে মন ভরে নি অমৃতের। শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, তিনি ভাবিত হলেন সারা গ্রাম নিয়ে। সিকিমের প্রত্যন্ত গ্রামগুলির সমস্ত শিক্ষিত তরুণ যুবকরা একটা পর্যায়ের পর গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হন জীবিকার অন্বেষণে। অমৃত চাইছিলেন, তাঁর নিজের ভাষায়, ফ্রম রুরাল টু আর্বানের এই যাত্রাপথের ভবিতব্যের টেবিলটা উল্টে দিতে। তিনি চাইলেন আর্বান টু রুরাল। গ্রামের অন্য তরুণ ও যুবকদের এ পথে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে খুব বেশি ঝামেলা পোয়াতে হয়নি অনূর্ধ্ব তিরিশের এই সপ্রতিভ যুবকটির।
তরুণ ও যুবকশূন্য গ্রামগুলি কেবল বৃদ্ধ ও মহিলাদের বসবাসের ঠিকানা হয়ে থাকুক এমনটা চাইছিল না সিকিম সরকারও। পর্যটন দফতরের আধিকারিক মনোজ ছেত্রী পরে বলছিলেন, "গোটা সিকিম জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র স্পট। পেলিং-গ্যাংটকের মত অতিপরিচিত জায়গাগুলিতে সর্বদা ভিড়। পর্যটকের বিরাম নেই। ফলে বিভিন্ন জায়গায় হোম স্টেগুলিতে উৎসাহ দেওয়াটাই আমাদের কাজ হয়ে দাঁড়াল, যে কাজে আমরা অনেকটাই সফল।"
অমৃত কেন ‘সকলের জন্য, সকলের সঙ্গে বিকাশ’-এর কথা ভাবতে চেয়েছিলেন সে প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাঁর সে সন্ধান তাঁকে নিজের গ্রামের আওতা থেকে বের করে নিয়ে পৌঁছে দেয় অন্যত্র। তার একটি জায়গা কামেরে।
সন্ধান ছিল স্বাতীরও। স্বাতী এক সময়ে মোটা মাইনের চাকরি করতেন। সে চাকরি ছেড়ে গত এক বছর ধরে তিনি পর্যটনোদ্যোগী। ব্যবসা তাঁর উদ্দেশ্য, লাভ তাঁর অভীষ্ট, কিন্তু সালামথাংয়ের ভিউপয়েন্টে মহালয়া পরবর্তী প্রতিপদের রাতে, নিচের উপত্যকার আলোকমালাকে সঙ্গী করে তিনি বলে ওঠেন, "কাস্টমার হিসেবে আমি মাস চাই না, ক্লাস চাই।" তাতে লাভ কিঞ্চিৎ কম হলেও পরোয়া করেন না মঁ ভয়াজের প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার স্বাতী রায়। "আমি সিলেরিগাঁওতে দেখেছি পূর্ণিমা রাতে যখন শিশিরের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, সে সময়ে একদল টুরিস্টের সৌজন্যে হঠাৎ সব খানখান করে বক্সে বেজে উঠল চটুল হিন্দি গান। পর্যটক হিসেবে আমি এই ক্যাটিগরিটাকে সার্ভ করতে চাই না।"
স্বাতী শহরের কোলাহলের বাইরে ইকো টুরিজম প্রোমোট করতে চান। এবং এ ব্যাপারে কোনও রকম আপোস করতেও নারাজ তিনি। বললেন, "কামেরে এলাকায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা মূলত নিরামিশাষী। আমি নিজে ভেজিটেরিয়ান নই, কিন্তু ওখানে যাঁরা থাকতে যাবেন, তাঁদের সে বাড়ির নিয়ম মেনেই থাকতে হবে। উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার অভিলাষীরা অন্য জায়গা দেখতেই পারেন।"
মহালয়ার রাতে আমরা ছিলাম কামেরেতে। কামেরেতে প্রবেশের মুখে গাড়ি দাঁড় করাতে হয়। সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন একদল নারীপুরুষ। তাঁরা অভ্যর্থনা জানাবেন আপনাদেরও, গলায় ফুলের মালা পরিয়ে, কপালে টিপ পরিয়ে।
পৌঁছোতে বিকেল হয়ে যাবে, শিলিগুড়ি থেকে ঘণ্টা চারেকের পথ। এখানে সন্ধে একটু তাড়াতাড়ি নামে, ঝপ করে নামে। সন্ধের মুখে ওখানকারই কারও মুখে আপনি শুনবেন কামেরের ভূতের চাষের কাহিনি। সন্ধের পর সেখানে কেউ যাবেন না, এরকম কোনও সাবধানবাণী ছাড়াই। চাইলে ওঁরাই আপনাকে নিয়ে যাবেন সেখানে। রাতের আঁধারেই।
(ক্রমশ)