নিয়োগ দুর্নীতি-সহ কয়লা ও গরু পাচার-কাণ্ড বঙ্গ রাজনীতিতে এখন অন্যতম প্রধান ইস্যু। শাসকদলের বিরুদ্ধে এই ইস্যুগুলিকেই হাতিয়ার করে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঝাঁপাচ্ছে বাম, কংগ্রেস ও বিজেপি। সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিরোধীদের বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছে।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরে দারুণ 'চার্জড' সিপিএমের তরুণ ব্রিগেড। তৃণমূলের 'ঘাস ফুল' আঁকা থাকা সব দেওয়াল হোয়াইটওয়াশ করে দিয়েছে বামেরা। সেখানে এবার কাস্তে-হাতুড়ি-তারা আঁকার কাজ চলছে জোরকদমে। আর এই দৃশ্য দেখার পরেও আশ্চর্যজনকভাবে নীরব স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। তাঁদের সাফাই, 'বিধানসভা ভোটে হোয়াইটওয়াশ হয়ে যাওয়া বামেরা আগামী দিনে শুধু দেওয়ালেই রয়ে থাকতে চাইছে।’
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে তৃণমূলের একের পর এক রাঘববোয়ালদের জালে পুরে চলেছে সিবিআই ও ইডি। এর সঙ্গে আবার রয়েছে
কয়লা ও গরু পাচার মামলা। যে মামলায় গ্রেফতার হয়ে বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের এখন ঠাঁই দিল্লির তিহাড় জেলে। অন্যদিকে, স্কুলে নিয়োগে দুর্নীতি মামলায় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ তাঁর আমলের প্রায় গোটা শিক্ষা দফতরটাই গারদের পিছনে রয়েছে। হাতে গরম একাধিক এমন ইস্যু পেয়ে শাসকদলকে গত কয়েকমাস ধরেই 'নাস্তানাবুদ' করে চলেছে বিরোধীরা। এর সঙ্গেই যোগ হয়েছে সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল। তৃণমূলের শোচনীয় হারে উজ্জীবিত কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপি।
এদিকে, সাগরদিঘির রেশ যাতে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও আছড়ে না পড়ে সেই ব্যাপারে এবার 'অতি সতর্ক' তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু করে টানা ৬০ দিন রাজ্যের সমস্ত পঞ্চায়েত এলাকায় ঘুরে-ঘুরে জনসংযোগ যাত্রায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন- দার্জিলিঙের রাস্তায় ব্ল্যাক প্যান্থার! মুহূর্তে ক্যামেরাবন্দি কালো চিতা
যদিও তৃণমূলের এই কর্মসূচিকে আমল দিতে নারাজ জামালপুরের সিপিএম কর্মীরা। তাঁরা নিজেদের কায়দাতেই পঞ্চায়েত ভোটের জন্য ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তৃণমূলকে টেক্কা দিতে পুরনো কায়দায় 'মাচা বৈঠক' করা থেকে শুরু করে দেওয়াল লিখন, মিটিং-মিছিল চলছে জোরকদমে। তারই মধ্যে দেওয়াল লেখায় তৃণমূলকে যেন একেবারেই ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে জামালপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার সিপিএমের তরুণ ব্রিগেড।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী অলক মাঝির সমর্থনে জামালপুরের শিবতলা থেকে হুসুমপুর পর্যন্ত চারটি বুথে দেওয়াল লেখা হয়েছিল। এখন ওই সব দেওয়ালেই কাস্তে- হাতুড়ি-তারা এঁকে তার পাশে পঞ্চায়েত ভোটে বাম প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কথা লেখা হয়েছে। একইভাবে দেওয়াল লেখা ও লাল পতাকায় এলাকা মুড়ে ফেলার কাজ চলছে জামালপুরের আরও একাধিক পঞ্চায়েত এলাকায়। যা দেখে কিছুটা হলেও 'হতাশ' তৃণমূল।
এদিকে, দলের তরুণ ব্রিগেড যে অধিকাংশ দেওয়ালের দখল নিয়েছে তা মানতে নারাজ সিপিএমের জামালপুর ১ নং এরিয়া কমিটির সম্পাদক সুকুমার মিত্র । তিনি বলেন, “দেওয়াল সিপিএমেরও নয়, তৃণমূলেরও নয়। দেওয়াল তো বাড়ির মালিকের। বাড়ির মালিক যে দলকে তাঁর দেওয়ালে লেখার অনুমতি দেবে তারাই লিখবে। জামালপুরের যে যে বাড়ির মালিক তাঁদের দেওয়ালে সিপিএম পার্টিকে লেখার অনুমতি দিয়েছেন সেখানেই আমাদের কর্মীরা লিখেছেন।''
আরও পড়ুন- দিল্লি দরবারে আবার পালটি ‘সাবালক’ মুকুলের, কেন? নেপথ্যে অন্তহীন চর্চা……..
তিনি আরও বলেন, ''আমাদের পার্টির সিদ্ধান্ত, বাড়ি মালিকের অনুমতি না নিয়ে দেওয়ালে লেখা যাবে না।'' সুকুমারবাবুর এই বক্তব্য থেকে খানিকটা হলেও বোঝা যাচ্ছে যে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে যে পরিবারগুলি তাঁদের বাড়ির দেওয়ালে তৃণমূলকে লিখতে দিয়েছিলেন তাঁরাই এখন তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। এপ্রসঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের সাফ জবাব, 'তৃণমূল এখন জনবিচ্ছিন্ন'।
তবে বিজেপি কিন্তু সিপিএমের এই অগ্রণী ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তারা আবার আগামী মঙ্গলবার রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে দিয়ে জামালপুরে সভা করিয়ে সিপিএম ও তৃণমূল দুই দলকেই ধাক্কা দিতে চাইছে। তারই প্রস্তুতি বৈঠকে যোগ দিতে রবিবার জামালপুরে এসে জেলা বিজেপি সভাপতি অভিজিৎ তা বলেন, 'এখন তো তৃণমূলে দেওয়াল লেখার লোক পর্যন্ত নেই। বাম-কংগ্রেস জোট কোথাও একটা দুটো দেওয়াল লিখে মিডিয়াকে ডেকে নিয়ে হাইলাইট করছে। কিন্তু বিজেপি কর্মীরা অসংখ্য দেওয়াল লিখলেও তা নিয়ে সিপিএমের মত ঢাক-ঢোল পেটাতে যায়নি। তাই হয়তো সেটা চোখে পড়ছে না।'
তবে তৃণমূল বিধায়ক অলক মাঝি কিন্তু বামেদের উপর ভীষণ চটেছেন। তিনি বলেন, “গা জোয়ারি করে সিপিএম কর্মীরা তৃণমূলের লেখা দেওয়াল দখল করেছে। প্রশাসনিকভাবে ছাড়াও দলীয়ভাবেও আমরা এর বিরুদ্ধে লড়ব। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে গোটা বাংলার মানুষ সিপিএমকে হোয়াইটওয়াশ করে দিয়েছে। তারপরেও ওরা এখন পঞ্চায়েত দখলের দিবাস্বপ্ন দেখছে। ওদের সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাবে। বাংলার মানুষের রায়ে পঞ্চায়েত ভোটের পর সিপিএমের অস্তিত্ব শুধু দেওয়ালেই রয়ে থাকবে।''