করোনা আবহের মধ্যেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ডেঙ্গু। উৎসব আবহে করোনা গ্রাফ বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাও। ফি বছর রাজ্যে বর্ষার শেষে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া সহ বিভিন্ন পতঙ্গবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এবারেও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। বর্ষার শেষে শহর এবং সংলগ্ন জেলাগুলিতে প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গি আক্রান্ত সংখ্যা। কপালে চিন্তার ভাঁজ প্রশাসনের। কলকাতা পুরসভার একাধিক বোরোতে মিলেছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। শুধু কলকাতা নয়, একাধিক জেলাতেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডেঙ্গির প্রকোপ।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বুঝবেন কী করে:
ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠ-সহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পিছনে ব্যথা অনুভব হতে পারে। জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচ দিনের সময় সারা শরীরে লালচে র্যাশ দেখা যায়। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমিও হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। এই অবস্থাটা যেকোনো সময় জটিল হয়ে উঠতে পারে। যেমন অন্য সমস্যার পাশাপাশি যদি শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। সঙ্গে মাথাঘোরা বুকে পেটে জল জমার মতও উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন:
ডেঙ্গু একটি পতঙ্গ বাহিত রোগ। ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকুন। ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হলে কোন পরিস্থিতিতে ডাক্তারের কাছে যাবেন, জানাচ্ছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক অতীন বন্দোপাধ্যায়।
• প্রচণ্ড জ্বর, দু-থেকে তিনদিন স্থায়ী হলে।
• শরীরের যেকোনও অংশে রক্তপাত হলে।
• শ্বাসকষ্ট হলে অথবা পেট ফুলে গেলে।
• প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে।
• জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিলে।
• অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে।
• প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে।
চিকিৎসা:
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই চলতে হবে। যাতে ডেঙ্গিজনিত কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয়। ডেঙ্গু জ্বরটা আসলে গোলমেলে রোগ, সাধারণত লক্ষণ বুঝেই চিকিৎসা করা দরকার। এক্ষেত্রে যে নিয়মগুলি মেনে চলা আবশ্যিক।
• সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে।
• যথেষ্ট পরমাণে জল, ডাবের জল তরল খাবার স্যুপ জাতীয় খাবার খেতে হবে।
• জ্বর কমানোর জন্য শুধু প্যারাসিটামল-জাতীয় ব্যথার ওষুধই যথেষ্ট। এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক-জাতীয় ব্যথার ওষুধ কোনোক্রমেই খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে।
• জ্বর কমানোর জন্য ভেজা কাপড় দিয়ে গা মোছাতে হবে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আপনার দায়িত্ব:
• বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
• ফুলদানির জল নিয়মিত বদলাতে হবে, অব্যবহৃত কৌটো, ডাবের খোলা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে।
• এডিস মশা সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য কোনো সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা শরীরে ভালোভাবে কাপড় দিয়ে ঢেকে বের হতে হবে, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরের দরজা-জানালায় নেট লাগালে ভাল।
• দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে।
• মশা নিধনের স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে।
• ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে করে কোনো মশা কামড়াতে না পারে।
• একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এই মশাবাহিত রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব।
স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন ডিরেক্টর, অমিতা হাটি বলেন,"গবেষণায় দেখা গেছে যে ডেঙ্গুর অন্যান্য স্ট্রেইনের তুলনায় DEN 2 বেশি প্রাণঘাতী। কিন্তু DEN 3 সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তাই, পর্যাপ্ত সেরোটাইপিংয়ের পাশাপাশি, এই স্ট্রেনের মধ্যে কোনটি বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে তাও আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে”।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু জ্বর ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপের কারণে হতে পারে, যেগুলিকে ডেন ১, ডেন ২, ডেন ৩ এবং ডেন ৪ নামে চিহ্নিত করা যায়। ডেন ৩ হল সবচেয়ে সাধারণ স্ট্রেন৷
ICMR-NICED এর প্রধান শান্তা দত্ত বলেন, "আমরা এপ্রিল মাস থেকে ডেঙ্গুর নমূনা পরীক্ষার কাজ করছি, পরীক্ষা করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি যে স্ট্রেনের সন্ধান পেয়েছি তা হল DEN 3, তারপর DEN 2 এবং DEN1"।
"যদিও এই স্ট্রেন ততটা গুরুতর নয়। তাও ডেঙ্গু আক্রান্তের ক্ষেত্রে চিকিৎসা এবং রোগীকে মনিটরিং করা বিশেষভাবে প্রয়োজন। উদ্বেগের বিষয়, যদি একজন রোগী যিনি আগে একটি নির্দিষ্ট স্ট্রেনে সংক্রামিত হয়ে থাকেন সেই সঙ্গে এখনক এই সময় বিভিন্ন স্ট্রেনে আক্রান্ত হন," সেক্ষেত্রে রোগীকে বাড়তি যত্ন ও চিকিৎসা একান্ত ভাবেই প্রয়োজন।