বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-এর ওয়ার্ল্ড ম্যালেরিয়া রিপোর্ট ২০২১-এ জানানো হয়েছে, ভারতে ম্যালেরিয়া কমছে। কিন্তু, তারপরও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর প্রায় ৮২ শতাংশের জন্য ভারতই দায়ী বলেই জানানো হয়েছে ওই রিপোর্টে। আর, এই সব কারণে যে মাসগুলোয় ম্যালেরিয়া বেশি হয়, সেই মাসগুলো শুধুই প্রশাসনের চিন্তা বাড়িয়েছে। বর্তমানে নতুন প্রযুক্তি এবং সরঞ্জাম নিয়ে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কোমর বেঁধে নেমেছে সরকার। লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূল কর। কিন্তু, কীভাবে সেটা সম্ভব? বাধাই বা কী কী? এনিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপের ই কুমার শর্মাকে বিস্তারিত জানিয়েছেন হু-এর প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্যা স্বামীনাথন।
এক্সপ্রেস- ডা. সৌম্যা, সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি জানেন যে, বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস ২০২২-এর থিম হল, 'ম্যালেরিয়া রোগ কমানো এবং জীবন বাঁচাতে উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগান' ম্যালেরিয়া নির্মূলে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
সৌম্যা- এটি স্বীকার করতেই হবে যে, কিছু দেশ ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে সফল হয়েছে। আমরা এখনও এই ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে আছি। শুধুমাত্র, ২০২০ সালেই বিশ্বে আনুমানিক ২৪ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর, ম্যালেরিয়ার জন্য গোটা বিশ্বে ৬,২৭,০০০ জন মারা গিয়েছেন। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার দাপট বরাবরই। বিশ্বের ৯৫ শতাংশ ম্যালেরিয়া সংক্রমণের ঘটনা এখানেই ঘটে। আবার, বিশ্বে ম্যালেরিয়া থেকে মৃত্যুর ৯৬ শতাংশ ঘটনাও এখানেই ঘটে।
তবে, এখন বেশ কিছু নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়েছে। যার সাহায্যে পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। সঙ্গে, কীটনাশক, জালের ব্যবহার, মশা মারার ব্যবস্থা, জিনবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ম্যালেরিয়া কমাতে সাহায্য করছে। এর সঙ্গে চিকিত্সা, ট্যাফেনোকুইন ট্যাবলেটের ব্যবহার, ম্যালেরিয়ার টিকা এই রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করছে। তার ওপর বিভিন্ন সংস্থা ম্যালেরিয়ার আরও শক্তিশালী টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে।
এক্সপ্রেস- ডা. সৌম্যা, মশার জেনেটিক পরিবর্তন ঘটিয়ে কি ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করা যায়? ভারতেও করা যাবে?
সৌম্যা- জিন পরিবর্তনের ব্যাপারটা আপাতত পরীক্ষামূলক স্তরে আছে। তার ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে হু এই ব্যবস্থা চালুর জন্য সুপারিশ করবে কি না। আপাতত তো ভারতে এটা চালু করা উচিত নয়। হু যে গাইডলাইন দিয়েছে, সেটাই মেনে চলা উচিত।
এক্সপ্রেস- অনেক বিশেষজ্ঞ তো ম্যালেরিয়া কমাতে ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। সেটা করা উচিত? ভারতে করাটা ঠিক হবে?
সৌম্যা- ওলবাচিয়া, স্বাভাবিকভাবে তৈরি হওয়া অন্তঃকোষীয় ব্যাকটেরিয়া। একে মশার মধ্যে প্রবেশ করালে এডিস মশার বৃদ্ধি রুখতে পারে। এমনটাই হু জানিয়েছে। তবে, আপাতত এডিস না। ওলবাচিয়াকে অ্যানোফিলিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
এক্সপ্রেস- ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং তাকে নির্মূল করার জন্য ভারতের কোন তিনটি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
সৌম্যা- ন্যাশনাল সেন্টার ফর ভেক্টর বার্ন ডিজিজেস, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক আর হু বর্তমানে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পর্যালোচনা করছে। পর্যালোচনার ফলের ভিত্তিতে ২০২৩ থেকে ২০২৭ পর্যন্ত ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা স্থির হবে। তবে, পরিকল্পনা যাই হোক না-কেন, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দরকার। তারা যাতে কাজটা করতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীও তাদের দিতে হবে। পাশাপাশি, গোটা বিষয়টার ওপর নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য বহু কর্মীও দরকার। আশাকর্মী থেকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার স্বাস্থ্যকর্মীদেরও কাজে লাগাতে হবে।
এক্সপ্রেস- পরিযায়ী শ্রমিকরা যেসব প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছেন, সেই ব্যাপারে কী বলবেন?
সৌম্যা- পরিযায়ী শ্রমিকদের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া-সংক্রমণ অনেক সময়ই গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে চলে আসছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, ম্যালেরিয়াবিহীন এলাকা থেকে শ্রমিকরা যেখানে কাজ করতে যায়, যেমন খননকাজ বা কৃষিকাজ করতে গিয়ে, সেখানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এসব রুখতে কঠোর নজরদারি দরকার।
এক্সপ্রেস- ওষুধ এবং কীটনাশক ব্যবহার করেও কি ম্যালেরিয়া রোখা যায়?
সৌম্যা- ওষুধ দিয়ে ম্যালেরিয়া পরজীবীকে রোখা যায়। আর, কীটনাশক দিয়ে পতঙ্গগুলো নির্মূল করা যায়। তবে, কোন ওষুধ কতটা কাজ করছে, তার ওপর নজর রাখতে হবে। একইরকম নজরদারি কীটনাশকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এছাড়া পতঙ্গ নিরোধক সরঞ্জামের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এনিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে।
এক্সপ্রেস- ডা. সৌম্যা, অনেকে বলছেন যে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব সব জায়গায় না। নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় রয়েছে। এই ব্যাপারে কী বলবেন?
সৌম্যা- ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের ব্যাপারে ভারত অগ্রগতি ঘটিয়েছে। তবে, বহু দুর্গম এলাকা আছে। উপজাতিদের এলাকা আছে। সেই সব এলাকায় পৌঁছনো বেশ কঠিন। ফলে, দুর্গম এলাকা এবং উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় অনেক সময়ই সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব হয় না। এই জন্য আশাকর্মীদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। তবে, দ্রুত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা এবং সঠিক সময়ে ওষুধ সরবরাহের ওপর জোর দিতে হবে। উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার কাছে যাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকে, সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সমতাই ম্যালেরিয়া নির্মূলের প্রেক্ষাপট তৈরি করবে। আরও ভালো স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে এনজিও বা সুশীল সমাজের সাহায্যও সরকার নিতে পারে।
এক্সপ্রেস- সীমান্তের ওপার থেকেও রোগব্যাধি ঢুকছে। আপনি কি মনে করেন, রোগব্যাধি ঠেকাতে সীমান্তের উভয়পারকেই হাতে হাত ধরে কাজ করতে হবে?
সৌম্যা- প্রথমেই আমি স্পষ্ট করে দিই যে নির্মূলের অর্থ হল, বিশ্বের সব দেশ থেকেই ম্যালেরিয়া নির্মূল করা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সমস্ত দেশেরই বর্তমান লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা। ২০১৮ সালে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অন্তত তেমনটাই স্থির হয়েছে। তেমনটা হলে, ২০৩০ সালের পর আফ্রিকার কয়েকটি দেশেই কেবল ম্যালেরিয়া থাকবে। বর্তমানে ভারত, ভুটান, নেপাল এবং বাংলাদেশের মধ্যে ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা রয়েছে। এটিকে যথাসম্ভব সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যেতে হবে। আমি বিশ্বাস করি যে একটি বিস্তৃত পরিকাঠামোই ম্যালেরিয়া শুধু নয়, সমস্ত ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে পারে।
এক্সপ্রেস- ভারতে ম্যালেরিয়া নির্মূলের জন্য জাতীয় কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে রোডম্যাপ (২০১৬-২০৩০)। সামগ্রিক রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। ম্যালেরিয়া, লিমফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস এবং ভিসারাল লেশম্যানিয়াসিসকে এর আওতায় নিয়ে এসে তিনটি রোগকে একেবারে নির্মূল করার পরিকল্পনা কার্যকর করার চেষ্টা করলে কি ভারত উপকৃত হবে?
সৌম্যা- ম্যালেরিয়া, লিমফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস এবং ভিসারাল লেশম্যানিয়াসিস নির্মূল করার কর্মসূচি একই দফতরের অধীন, তা হল- জাতীয় ভেক্টর বার্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম। সুতরাং, এই তিনটি রোগকে একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজ্য এবং জেলাগুলোয় একটি 'ট্রিপল নির্মূল পরিকল্পনা' করা হয়েছে। তবে, প্রতিটি রোগের জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচি রয়েছে। কেবল বার্ষিক পর্যালোচনা, পরিকল্পনা বৈঠক, প্রশিক্ষণ, তত্ত্বাবধান এবং পর্যবেক্ষণ এবং নজরদারিটা একসঙ্গে করা যেতে পারে।
এক্সপ্রেস- কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকে বাধা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই মহামারি নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। উন্নত নজরদারি, স্ক্রিনিং, ডেটা শেয়ারিং, ভ্যাকসিন ডেলিভারি এবং ডোরস্টেপ সার্ভিস ডেলিভারি এই সব উদ্যোগের অন্যতম। বিশ্বব্যাপী কোভিড সমস্যা থেকে আমরা কী শিখতে পারি, যা ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারতে প্রয়োগ করা যেতে পারে?
সৌম্যা- কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন ভারতে ম্যালেরিয়া নির্ণয় ও চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটেছে। হু-র একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২০২০ সালে ভারতে ম্যালেরিয়া নির্ণয় এবং চিকিত্সা ৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাহত হয়েছে। মহামারীর আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে ম্যালেরিয়া ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাগুলো ৩০ শতাংশেরও বেশি কম হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ম্যালেরিয়া রুখতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নজরদারি, মহামারী রোখার প্রস্তুতি, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, কেন্দ্র এবং রাজ্য এবং জেলাগুলোর মধ্যে ভাল সমন্বয় অপরিহার্য। কীভাবে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করা যায়, তা নিয়ে সম্পূর্ণ-সমাজ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করা উচিত। ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী, নেতা, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার, কর্পোরেট সেক্টর, বিভিন্ন সংস্থার নির্বাচিত কর্তাদের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে কীটনাশক, মশারির ব্যাপক বিতরণ করা উচিত।
এক্সপ্রেস- গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে যে জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্ন অঞ্চলে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ বাড়াবে। এমনকী, যে অঞ্চলগুলি এতদিন ম্যালেরিয়ামুক্ত ছিল, সেখানেও তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতার বৃদ্ধি ম্যালেরিয়া বহনকারী মশার বিস্তার ঘটাতে পারে। আপনার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ ও ম্যালেরিয়া নির্মূলের কৌশল কী হতে পারে?
সৌম্যা- জলবায়ু পরিবর্তন ম্যালেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর পরিবর্তে বাড়াতে পারে। বিভিন্ন জন এমনটা বললেও, আজ পর্যন্ত এমন কোনও প্রমাণ নেই যে জলবায়ু পরিবর্তন ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূলের চেষ্টাকে প্রভাবিত করছে। তাই, এনিয়ে অযথা আতঙ্কিত হওয়ারও কিছুই নেই।