বিজেপির থেকে তৃণমূলকেই এখন অপেক্ষাকৃত 'ভাল' মনে করছেন অধ্যাপিকা তথা শোভন-বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু হঠাৎ এমন 'বোধোদয়ের' কারণ কী? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বৈশাখী সোমবার বলেন, ‘‘মমতা যখন আমার সম্পর্কে চরম খারাপ কথা বলেছেন, তখন কিন্তু তিনি এটাকে মিডিয়া ট্রায়াল হতে দেননি। উনি আমার নাম নিয়ে প্রকাশ্যে একটাও কথা বলেননি’’। অথচ, বিজেপি যেভাবে তাঁর ‘সম্মানহানি’ করছে, তাতেই তিনি ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ। বৈশাখীর চাঞ্চল্যকর অভিযোগ, শোভন চট্টোপাধ্যায়কে দলে নিয়ে বৈমাত্রেয় আচরণ করছে বিজেপি, তাঁকে কোনও কাজ দেওয়া হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, ক’দিন আগেই সাংবাদিক সম্মেলনে কাঁদতে কাঁদতে বৈশাখী বলেছিলেন, ‘‘দিদিকে বলতে চাই, আপনি (মমতা) কি সত্যিই নির্দেশ দিয়েছেন যে, সাম্প্রদায়িক তকমা দিয়ে আমার চাকরি খেয়ে নেবেন?’’ এ দৃশ্যের পর শোভন-বৈশাখীকে কেন্দ্র করে অনেক জল গড়িয়েছে। গত ১৪ অগাস্ট বিজেপির সর্বভারতীয় সদর দফতরে পদ্ম পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন কলকাতার প্রাক্তন মহানাগরিক এবং তাঁর বান্ধবী। যোগদানের দিন থেকেই সেদিন শোভন-বৈশাখীর পদ্ম সরণির যাত্রাপথে দেবশ্রী কাঁটা বিঁধেছে।
আরও পড়ুন: মুকুলের খেলা? দেবশ্রীকে কে নিয়ে গিয়েছিলেন বিজেপি দফতরে, রহস্যভেদ করলেন বৈশাখী!
পরবর্তীকালে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৈঁছেছে যে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার দু’সপ্তাহের মাথাতেই দল ছাড়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন দু'জনেই। আর এরপরই তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে ফারাকটা যেন প্রকট হয়ে উঠেছে শোভন-বৈশাখীর চোখে। মাত্র কয়েক দিন আগেই ‘নিজের সবথেকে বেশি ক্ষতির জন্য’ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘দায়ী’ করেছিলেন বৈশাখী, সেই বৈশাখীর গলাতেই এবার শোনা গেল 'বোধোদয়ের সুর'। বৈশাখী বললেন, মমতা তাঁর নাম নিয়ে প্রকাশ্যে একটাও কথা বলেন নি। বৈশাখীর এমন সুর বদল রীতিমতো তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
উল্লেখ্য, তাঁদের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হচ্ছে, সম্মানহানি করা হচ্ছে, তাই ‘অনাহুতের মতো কাজ করা সম্ভব নয়’ বলে বিজেপি ছাড়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন শোভন-বৈশাখী। এরপরই শোভন-বৈশাখী তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির আদর্শগত ফারাক বুঝতে পেরেছেন বলে ব্যাখ্যা রাজনীতির কারবারিদের একাংশের। এদিন এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বৈশাখী বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন আমার সম্পর্কে চরম খারাপ কথা বলেছেন, তখন কিন্তু তিনি এটাকে মিডিয়া ট্রায়াল হতে দেননি। উনি একটাও কথা প্রকাশ্যে আমার নাম নিয়ে বলেননি। যেহেতু ওঁর দলে উনিই শেষ কথা। সেজন্য, হয়তো নিয়মানুবর্তিতা ওখানে অনেকটা বেশি মেনে চলা হয়। ফলে আমাদের ডিল করতে অসুবিধে হয়নি’’। শুধু তাই নয়, এ প্রসঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরও নাম করে বৈশাখী বলেন, ‘‘আমি তখন তৃণমূলে ছিলাম। একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। একজন উচ্চারণ করেছিলেন, ওঁরা নব্য তৃণমূল, বিজেপি ঘেঁষা... তখন কিন্তু ওয়েবকুপার মাথায় বসে থাকা শিক্ষামন্ত্রী এই ধরনের মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন’’। বৈশাখী আরও বলেন, ‘‘একটা দলের কাজ নিরাপত্তা দেওয়া, মিথ্যাচার করা নয়’’। তাহলে কি বিলম্বিত বোধোদয় হল বৈশাখীর? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, "কোনও অনুশোচনা নেই।" তবে, তৃণমূলে ফেরার যে কোনও প্রশ্নই নেই, এদিন সে কথাও দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছে এই অধ্যাপিকা।
আরও পড়ুন: বৈশাখীকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ, পুলিশের দ্বারস্থ শোভন-বান্ধবী
এদিকে, বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে কি মিটমাট হল? জবাবে বৈশাখী বলেন, ‘‘দিলীপবাবু কোনও আলোচনার প্রস্তাব দেননি। তাই সমাধানসূত্র বেরনোর জায়গা নেই। কৈলাশজিকে স্পষ্ট করে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি। বলেছি, বিজেপির লোকেরা আমাদের চায় না। অনাহুতের মতো কাজ করা সম্ভব নয়’’। একইসঙ্গে বৈশাখী বলেন, ‘‘বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তো রাজ্যে এসে দল চালাবেন না। রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে সুষ্ঠু সম্পর্ক না হলে, কাজ করা সম্ভব নয়’’। এরপরই বিজেপি নেতৃত্বের একাংশকে বৈশাখীর তোপ, ‘‘অনেকে বলছেন বটে বিজেপির নিয়ম-নীতিকি মেনে চলতে হবে, কিন্তু, বিজেপিতে নিয়ম নীতি মেনে চলা হয় কি না তা ঠিক জানি না। আমাকে যেভাবে প্রজেক্ট করা হয়েছে, অসত্য তথ্য পরিবেশন করে, আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে তা তো ঠিক নয়। আমি নাকি পদ চাই, সমগুরুত্ব চাইছি শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো, এ সব বলা হচ্ছে! মানুষের মনে আমাদের সম্পর্কে একটা ভুল ছবি তুলে ধরা হচ্ছে। আমি নাকি কৈলাশজির নেতৃত্ব মানতে পারছি না বলে দল ছাড়তে চাইছি। কৈলাশজির সঙ্গে দুবার দেখা হয়েছে, প্রতিবারই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি ও শোভনবাবু যখন এমন একটা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তখন ওই নেতারা (যাঁরা কুকথা ছড়াচ্ছেন ) ভাবছেন, হয়তো তাঁদের নাম এবার সামনে চলে আসবে। তাঁরা আসলে এক ধরনের ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতি করেছেন’’।
এক্সক্লুসিভ শোভন: মমতাকে তৈরি করতে সব নষ্ট করে জীবন দিয়েছিলাম, আর উনিই রাজনীতি করলেন
বিজেপি নেতৃত্বের উপর ক্ষোভ উগরে এদিন বৈশাখী আরও বলেন, ‘‘দলে যোগ দেওয়ার পর থেকে ১৪ দিনের বেশি হয়ে গেল, কেউ কাজের কথা বলছেন না, রাজনৈতিক কর্মসূচি করছেন না। শোভনবাবু একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিক, দক্ষিণ কলকাতা মণ্ডল সভাপতিও দেখা করেন নি ওঁর সঙ্গে। বরং তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন বলে একজনকে শোকজ করা হয়েছে। তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের প্রতি এমন মনোভাব থাকলে, বিজেপির উচিত দরজাটা বন্ধ করে রাখা। দলে নেওয়ার পর বৈমাত্রেয় আচরণ করছেন, এতে দলেরই ঐক্যের ক্ষতি হচ্ছে।"