প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লালকেল্লা থেকে দেওয়া তাঁর ভাষণে আরও একবার সারা দেশে একসঙ্গে নির্বাচনের কথা বলেছেন। এ অবস্থান তাঁর দীর্ঘদিনের। এবার ভোটে জেতার পর তিনি জানিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছে।
এক দেশে এক নির্বাচন বিষয়টি কী? একসঙ্গে ভোট হলে কী সুবিধে হবে, কেনই বা এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বেশ কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দল?
পক্ষে ও বিপক্ষের যুক্তিসমূহ
লোকসভা ভোট ও সারাদেশের সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট একসঙ্গে করার পক্ষে ও বিপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি রয়েছে।
এক দেশ এক নির্বাচন হলে ভোটের খরচ কমবে, সব ভোট একই সঙ্গে হয়েও যাবে। এখনকার ব্যবস্থায় সব সময়েই ভোট হয়ে চলেছে এবং আদর্শ আচরণবিধি লাগু থাকার কারণে জনসাধারণের স্বার্থে বিভিন্ন প্রকল্প বা নীতি ও পরিকল্পনা ঘোষণা করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে সমালোচকদের অভিযোগ, একটি মেগা ভোট হলে ভারতের মত বড় দেশে অনেক রকম সমস্যা হবে। একটা বড় যুক্তি হল একসঙ্গে সব ভোট হলে এখন যা ভোটিং মেশিন লাগে তার দ্বিগুণ মেশিন ও ভিভিপিআইটি লাগবে।
আরেকটা বড় যুক্তি হল, একসঙ্গে ভোট হলে জাতীয় পর্যায়ে শক্তিশালী দলগুলি অনেক বেশি সুবিধে পাবে আঞ্চলিক দলগুলির তুলনায়, সহজ করে বলতে গেলে বিজেপি সবচেয়ে বেশি অন্যায্য সুবিধা পাবে। আরও একটা যুক্তি হল, যদি কোনও সরকার মেয়াদের আগে পড়ে যায়, তাহলে কী হবে?
আরও পড়ুন, দেশের সুরক্ষায় কোন শক্তিশালী পদ বানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী?
শুরুতে এমনটাই ছিল
ভারতে শুরুতে সব ভোট একসঙ্গেই হত। লোকসবা ও বিধান পরিষদের ভোট ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে হয়েছিল একসঙ্গেই। কেরালায় ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে জওহরলাল নেহরু ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে নামুদ্রিপাদ নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকার ভেঙে দেন। কেরালায় নতুন করে পাঁচ বছরের বিধানসভা শুরু হয় ১৯৬০ সালে।
এখন শুধু অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িশা, অরুণাচল প্রদেশ এবং সিকিমে লোকসভা ভোটের সঙ্গে বিধানসভা ভোট হয়ে থাকে।
আগেও এ কথা ভাবা হয়েছিল
৩৫ বছর আগে, ১৯৮৩ সালে নির্বাচন কমিশন একসঙ্গে ভোটের কথা বলেছিল। বিচারপতি বি পি জীবন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন ১৯৯৯ সালের মে মাসে ১৭০ তম রিপোর্টে বলেছিল, আমাদের পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতেই হবে, যে সময়ে সোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসঙ্গে হত।
২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধীর কাছে বিষয়টি তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা নিয়ে খুব চাপাচাপি করা হয়নি।
২০১০ সালে এল কে আদবানি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করার পর ইন্টারনেটে পোস্ট করেন। তিনি লেখেন, এ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় খোলা মনে নিয়েছেন। এক বছর অন্তর ছোট সাধারণ নির্বাচন আমাদের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়, লিখেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন, প্রধানমন্ত্রী মোদী কেন আলাদা চোখে দেখতে বললেন সম্পদ সৃষ্টিকারীদের?
মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর
২০১৫ সালে সংসদের এক স্ট্যান্ডিং কমিটি লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন এক সঙ্গে অনুষ্ঠিত করার ব্যাপারে একটি রিপোর্ট পেশ করে। ওই রিপোর্টে বলা হয় বেশ কিছু বিষয় খর্ব করা যাবে একসঙ্গে ভোট হলে,
১) খরচ
২) নির্বাচনের সময়ে আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি লাগু থাকার ফলে যে নীতি পঙ্গুত্ব তৈরি হয়
৩) জরুরি পরিষেবা প্রদানের সমস্যা
৪) নির্বাচনের সময়ে প্রয়োজনীয় লোকনিয়োগের চাপ
কংগ্রেস এ প্রস্তাবকে অবাস্তবোচিত বলে গণ্য করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের বক্তব্য এ শুধু অগণতান্ত্রিকই নয়, অসাংবিধানিকও বটে। সিপিআই ও এনসিপি বলেছে, সম্ভব নয়। সিপিএম এর বাস্তব সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
২০১৭ সালে সংসদের যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন ঘনঘন ভোটের ফলে উন্নয়নমূলক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে, স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। আরও কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন তিনি। উল্লেখ্য সংসদের যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ তৈরি করে সরকার।
সে বছরই নীতি আয়োগের বিবেক দেবরায় ও কিশোর দেশাই এক আলোচনায় দেখান, ২০০৯ সালের ভোটে ১১১৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে এবং ২০১৪ সালে খরচ হয়েছে ৩৮৭০ কোটি টাকা। দল এবং প্রার্থীদের খরচ আলাদা করে ধরলে তা অনেকগুণ বেশি হবে বলে দেখান তাঁরা।
২০১৮ সালের ৩০ অগাস্ট এক খলড়া রিপোর্টে বিচারপতি বি এস চৌহানের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন বলে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী একসঙ্গে ভোট করা সম্ভব নয়। এ জন্য সংসদের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে বলে বলা হয় ওই রিপোর্টে।
কমিশনের তরফ থেকে প্রস্তাব করা হয় একটি ক্যালেন্ডার বর্ষে যতগুলি ভোট হওয়ার কথা সেগুলি একসঙ্গে করা হোক।
এ বছরের জুন মাসে সংসদের যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলেন, "এক দেশে একসঙ্গে নির্বাচন এখন সময়ের দাবি, যার ফলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, তার ফলে দেশের মানুষের সুবিধা হবে।"
আরও পড়ুন, ছত্তিসগড়ে মাওবাদীদের মোকাবিলা কীভাবে করছে নিরাপত্তা বাহিনী?
এখন কী হবে?
এ প্রস্তাবে বিরোধীরা রাজি হবে না বলেই মনে হয়। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আবেদন যে ভাবে সারা দেশে সাড়া ফেলেছে, তা একেবারেই অভূতপূর্ব, এবং সারা দেশে একসঙ্গে নির্বাচন ও প্রচার বিজেপিকে দেশ জুড়ে প্রভূত সুবিধে দেবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর এ ব্যাপারে স্পষ্ট উচ্চারিত দায়বদ্ধতা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে এ নিয়ে বিজেপি যতদূর সম্ভব ততদূর যাবে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার আওতায় বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের উদাহরণ থেকে স্পষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নীতির ক্ষেত্রে যে কোনও পদ্ধতি নিতেই তারা পিছ পা নয়। তবে এ বিযয়টা আরেকটু জটিল।
Read the Full Story in English