বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনিই 'প্রথম'। আন্তর্জাতিক মঞ্চে লাখো লাখো বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী জনতা তাঁর ব্যাটেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন প্রথমবার। হবে নাই বা কেন! শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ যে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ও তার পরের বছর আন্তর্জাতিক টেস্টের বাইশ গজে সবুজ-লাল জার্সিতে প্রথমবার ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করেছিলেন। বাংলাদেশের সেই 'প্রথম' ব্যাটসম্যানই এবার পা রাখতে চলেছেন ইডেনে।
ভারতে রওনা দেওয়ার আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-বাংলাকে কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বলছিলেন, "স্বপ্ন ছিল ইডেন গার্ডেন্সে খেলব। কিন্তু ব্যাট নিয়ে ইডেনের ২২ গজে নামার স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেছে। এবার দাদা (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) আমাকে সেই সুযোগ করে দিলেন। খেলতে পারিনি তো কী হয়েছে, দাদা ইডেনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, এটাই তো বিশাল ব্যাপার। প্রথম দিন-রাতের টেস্টে হাজির থেকে ইতিহাসের অংশ হয়ে যাব। এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি!"
যখন ব্যাট করতে নামতেন, হাজার ওয়াটের লাইমলাইট তাঁর উপরে ঠিকরে পড়ত। এখন ক্রিকেট থেকে বহুদূরে। অন্য গোলার্ধের বাসিন্দা তিনি। পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী পরিচয় নিয়ে বাঁচেন। ব্যবসায় মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছেন এতটাই, যে খেলাটা ঠিকঠাক দেখাও হয়ে ওঠে না। সেই শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ইডেন গার্ডেন্সে আসার আমন্ত্রণ পেয়ে আবেগে ভাসছেন। প্রহর গুনছেন ক্রিকেটের স্বর্গোদ্যানে পা ফেলার।
আরও পড়ুন, ভারতের কাছে হেরে তিন মাস ঘুমোননি মুশফিকুর, দিল্লি দখলের পরে জানালেন বাবা
সাধ ছিল ইডেনে বল-ব্যাটের সংঘর্ষ ঘটাবেন। কিন্তু সাধ আর সাধ্যে পরিণত হয় নি। এবার সেই সুযোগই করে দিয়েছেন স্বয়ং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। এভাবেও যে স্বপ্নপূরণ হয়, সেটা ভাবেননি শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। মহারাজের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে বিদ্যুৎ বলতে থাকেন, "এত বড় সম্মান দেখাবেন দাদা, ভাবতে পারিনি। দাদা বাংলাদেশকে ভোলেননি, আমাদেরকেও ভোলেননি। সবাইকে আলাদা আলাদা করে চিঠি পাঠিয়েছেন। উনি মনের দিক থেকে অনেক বড়। তা না হলে এত বড় পদে থেকেও আমাদের মনে রাখেন! এর চেয়ে বড় সম্মান আর কী হতে পারে!"
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ-এর নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ এবং প্রথম টেস্টে তিনিই প্রথম বলের মুখোমুখি হয়েছিলেন। প্রথম টেস্টের স্মৃতি এখনও তাঁর কাছে জীবন্ত। অতীতের স্মৃতি ঘেঁটে গড়গড় করে বলতে থাকেন, "মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। প্রথম ওভারেই আমি জাভাগাল শ্রীনাথের মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেইসময় দুনিয়ার সমস্ত বড় বড় বোলারদের মুখোমুখি আমিই হতাম। সত্যি বলতে, প্রথম টেস্টে সেটা ছিল স্বপ্নের এক মুহূর্ত। আমি ছিলাম ওপেনার। দাদাও তাই। ওঁর কাছ থেকেই টিপস নিয়েছিলাম, কীভাবে টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘক্ষণ ক্রিজে টিকে থাকা যায়।"
সৌরভের বাংলাদেশ-প্রেম নিয়ে মহাকাব্য লেখা যায়। ক্রিকেটার হিসেবে হোক বা প্রশাসক হিসেবে, সৌরভ বরাবরই বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছেন। সেই কথা স্মরণ করে দিয়ে বিদ্যুৎ বলছিলেন, "যখন খেলতাম, তখন থেকেই দেখতাম দাদার বাংলাদেশের প্রতি আলাদা টান। প্রথম টেস্টের সময়েই দেখেছি, উনি ড্রেসিংরুমে এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতেন। আপন করে নিতেন আমাদের। আমাদের কাছে সেটাও কল্পনাতীত পাওনা। অভিষেক টেস্টের প্রত্যেককে ইডেনে আমন্ত্রণ জানিয়ে দাদা প্রমাণ করেছেন তিনি শুধু বড় ক্রিকেটার নন, মানুষ হিসাবেও অনেক বড় মাপের।"
আরও পড়ুন, হাসিনাকে জানানো উচিত ছিল শাকিবের, সাফ জানাচ্ছেন বাংলাদেশের মন্ত্রী
বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটপ্রেমী মনে করেন, দাদা ভারতীয় বোর্ডের সভাপতি হওয়ায় বাড়তি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। সাধারণের মতো সাবেক বাংলাদেশি ওপেনারের মুখেও একই কথা, "দাদা থাকলে আমাদের ক্রিকেটের অগ্রগতিই ঘটবে। একজন ক্রিকেটারই অন্য ক্রিকেটারের কষ্ট বোঝেন। দাদা এসেই তো ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতন বাড়িয়ে দিয়েছেন। দাদা শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটার ছিলেন। উনি ক্রিকেটারদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো খুব ভাল করেই বোঝেন। দাদার বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা অনুভূতি রয়েছে। আমার মনে হয়, ওঁর কাছ থেকে বাংলাদেশও সুবিধা পাবে।"
বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার ছিলেন। তবে বেশিদিন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি তিনি। ২০০০-এর নভেম্বরে অভিষেক টেস্ট খেলেছিলেন। তারপর যেখানে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ-এর নিয়মিত টেস্ট খেলার কথা ছিল, সেখানে উল্টোটাই হয়েছে। চার বছর পর ২০০৪ সালে খেলেন কেরিয়ারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় টেস্ট। সে বছরই রাগে ক্ষোভে বোর্ডকে চিঠি দিয়ে ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন অভিমানী বাংলাদেশি ওপেনার।
আরও পড়ুন, এক টেস্ট খেলেই বিদায়! ইডেনে বিকাশের যন্ত্রণার শরিক হবেন শচীন-সৌরভও
সেই যন্ত্রণা-কষ্ট এখনও দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে। খেলা ছাড়ার এতদিন পরেও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সেই কষ্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ ধরা গলায় বলতে থাকেন, "আমি নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছিলাম। কখনও টাকার জন্য খেলিনি। অর্থের চেয়ে সম্মানকেই সবসময় প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। ২০০৩-এ অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে আমি জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নারায়ণগঞ্জের হয়ে চট্টগ্রামের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করি। প্রত্যাশা ছিল, অস্ট্রেলিয়া সফরে দলে নিশ্চয় সুযোগ পাব। কিন্তু ক্যাম্পে ডাক পেলেও আমাকে নির্বাচিত করা হয়নি। 'এ' দলের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। প্রচণ্ড রাগে নিজেই বিকেএসপি থেকে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম।"
আরও পড়ুন, ইডেনে স্বপ্নপূরণের আমন্ত্রণ, অপেক্ষায় সৌরভের প্রিয় শান্ত
অভিমানী ক্রিকেটার ডাকাবুকো মেজাজে ব্যাটিং করতেন। ১৯৯৯ সালে মেরিল ইন্টারন্যাশনাল ত্রিদেশীয় সিরিজের আগে এমসিসি-র বিপক্ষে দুই ইনিংসেই শতরান হাঁকিয়েছিলেন। ত্রিদেশীয় সিরিজে কেনিয়ার বিপক্ষে মহম্মদ শেখের বলে লেগ বিফোর হওয়ার আগে ৯৫ রানের দুরন্ত ইনিংস উপহার দিয়ে যান। সেই সময় সেটাই ছিল কোনো বাংলাদেশির সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। যদিও তাঁর রেকর্ড বেশিদিন টেকেনি। সেই সিরিজেই জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম শতরান করার কীর্তি গড়েন তাঁরই ওপেনিং পার্টনার তথা বন্ধু মেহরাব হোসেন অপি। সেই ম্যাচেই বিদ্যুৎ-মেহেরাব হোসেন ওপেনিং জুটিতে তুলে ফেলেছিলেন ১৭০ রান।
দুরন্ত পারফরম্যান্সের জেরে দুই তারকাই বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা পেয়েছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে দুরন্ত জয়ে বিদ্যুৎ খেলেন ৩৯ রানের ইনিংস। তার পরেও জাতীয় দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন তিনি। তৎকালীন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদের বিপক্ষে ক্ষোভ উগরে দিয়ে প্রাক্তন ওপেনার বলেন, "সেই সময় প্রধান নির্বাচক ছিলেন ফারুক ভাই। এটা ২০০৪ সালের ঘটনা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে একটি ওয়ান-ডেতে ফিল্ডিং করার সময় থ্রো করতে গিয়ে পিঠে চোট পাই। ফিজিও পরীক্ষার পর জানিয়েছিলেন, ওয়ান-ডে সিরিজে বিশ্রাম নিলে টেস্ট খেলতে পারব। হঠাৎই একদিন আমার কোচ ড্যাভ হোয়াটমোরের রুমে ডাক পড়ে। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন অধিনায়ক সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার) ও ফারুক ভাই। আমি তাঁদের বলেছিলাম, ওয়ান-ডে সিরিজ শেষ হওয়ার পর টেস্ট সিরিজ খেলতে চাই। কিন্তু ফারুক ভাই আমাকে চাননি। তিনি বদলির খোঁজ করা শুরু করলেন।"
আরও পড়ুন, নেতা সৌরভের প্রথম প্রতিপক্ষই অভিষেক টেস্টে নামা বাংলাদেশ, কোথায় এখন তাঁরা
এরপরে তাঁর আরও সংযোজন, "তখনই বুঝে যাই, ফারুক ভাই আমাকে আর ডাকবেন না। কেরিয়ারে তৈলমর্দন করে খেলতে চাইনি। বাড়ি ফিরে বাবা-মা এবং স্ত্রী’র সাথে কথা বলে বোর্ডকে চিঠি দিয়ে বিদায় জানিয়েছি। আজ এতদিন পর সেসব আমি আর মনে রাখিনি। মনে রাখার চেষ্টাও করি না। এখনও ফারুক ভাইয়ের সাথে আমার ভাল সম্পর্ক। নারায়ণগঞ্জে পৈতৃক ব্যবসায় মন দিয়েছি। বর্তমানে এত ব্যস্ত যে ক্রিকেটের কোনও অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারি না।"
কর্মব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে বাংলাদেশের খেলা দেখেন। প্রিয় ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। তাঁর সঙ্গে নিজের ব্যাটিংয়ের মিল খুঁজে পান। সেই তামিম পারিবারিক কারণে ভারত সফরে যেতে পারেননি। উল্টোদিকে, শাকিব আল হাসান নিষিদ্ধ হওয়ায় খর্বশক্তির দলই গিয়েছে ভারতে। ইন্দোর টেস্টে বড় হারের পর কলকাতায় ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বাংলাদেশ দল। প্রাক্তন এই ওপেনার আশাবাদী, কলকাতায় গোলাপি বলে ভালই করবেন মুশফিকুর-মুমিনুলরা, "কলকাতার আবহাওয়া আর বাংলাদেশের আবহাওয়া একই। ওখানে খেললে মুশফিকরা ঘরের আমেজই পাবে। তাছাড়া পিচও এত আলাদা হবে না। আমরা উপস্থিত থাকব। গ্যালারি থেকে গলা ফাটাব ওঁদের জন্য। ভাল না খেলার তো কারণ নেই!"
শুধু শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ নন, অভিষেক টেস্টের পুরো দলই ইডেনে হাজির থাকবেন। ভিভিআইপি বক্সে বাংলাদেশের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুশফিকুর-মুমিনুলদের ভালো না খেলে উপায় আছে!