Football World Cup Trivia 2018:
মিঠুন ভৌমিক
আগের পর্বে লিখেছিলাম আইসল্যান্ডের কথা। অতটুকু একটা দেশের বিশ্বকাপ খেলতে আসা নিয়ে উন্মাদনার বিস্ফোরণ নিয়ে এখন আলোচনা তুঙ্গে। প্রথম ম্যাচেই আর্জেন্তিনাকে আটকে দিয়েছে আইসল্যান্ড, একথা বললে অর্ধেকটা বলা হয়। খেলা দেখতে দেখতে এক এক সময় মনে হচ্ছিল ম্যাচটা আইসল্যান্ড জিতেও যেতে পারে। কিন্তু সেতো অনেক পরের কথা। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই দেখে নেওয়া যাক, কী কী হলো।
যেকোনো খেলাধুলোর ইভেন্টের শুরুর দিনটি খুবই তাৎপর্য্যপূর্ণ। প্রথম ম্যাচে নিয়মমাফিক রাশিয়া খেললো সৌদি আরবের বিরুদ্ধে। প্রত্যাশামতই রাশিয়া জিতেছে, যদিও স্কোরলাইন অপ্রত্যাশিত হয়েছে। খেলা শুরুর প্রথম দু মিনিটে সৌদী আরবকে দেখে মনে হয়নি তারা আন্ডারডগ। বরং রাশিয়া খুবই সাদামাটা ছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করছে শুধু রাশিয়া, খেলা চলছে সৌদির অর্ধেই। শেষ পর্যন্ত ৫-০ জিতে গেলো রাশিয়া। প্রসঙ্গত, ফুটবলের আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাশিয়ার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর থেকে হিসেব করলেও এই নিয়ে চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলা হয়ে গেল। আর সোভিয়েত ভাঙার আগের যুগ তো রীতিমত সোনার! ১৯৫৮ থেকে ’৭০ টানা চারটে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে ইউ এস এস আর, তার মধ্যে ’৬৬র বিশ্বকাপে সেমিফাইনালেও উঠেছিলো তারা, যা সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে তাদের শ্রেষ্ঠ ফল। ১৯৮০-১৯৯৫ যাঁরা আন্তর্জাতিক ফুটবল দেখেছেন তাঁদের মনে থাকবে দূরদর্শনের একটাই চ্যানেলে ছোট ছোট ক্লিপে বিভিন্ন দেশের চোখ জুড়োনো খেলা, যার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের উজ্জ্বল উপস্থিতি। সোভিয়েত ভাঙ্গার পর অবশ্য সেই রমরমা আর নেই। এই মুহূর্তে ফুটবল মানচিত্রে রাশিয়া তেমন বড়ো কোনো নাম নয়। এবারেও তারা শেষ চারে যাবে এমন আশা কম। তবে ফুটবল কিনা প্রবল অনিশ্চিয়তার খেলা, তাই “কখন কী ঘটে যায় – কিচ্ছু বলা যায়না”।
রাশিয়ার পাশে ট্র্যাডিশনে সৌদি নেহাতই আন্ডারডগ। খবরে প্রকাশ, ৫ গোলে হার মেনে নিতে পারছেন না সৌদী প্রশাসন, এবং শাস্তি হতে চলেছে তিন ফুটবলারের, যাঁদের মধ্যে দুজনই রক্ষণভাগের খেলোয়াড়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, এত টাকাপয়সা খরচ করার পরে এই ফল মেনে নেওয়া যায়না। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তথ্য হিসেবে রাখা থাক, অতীতে ফ্রান্সের কাছে ৪-০ (১৯৯৮), জার্মানীর কাছে ৮-০ (২০০২), ও ইউক্রেনের কাছে ৪-০ (২০০৬) হারের নজির আছে সৌদির। ১৯৯৪ সালে বেলজিয়ামকে ১-০ গোলে হারানো বাদ দিলে, সেইভাবে কোনো বিশ্বকাপেই নজর কাড়েনি তারা।
চলে আসি পরের খেলাগুলোয়। আহত সালাহকে বাইরে রেখেই মাঠে নামা মিশরকে শেষ মুহূর্তের গোলে হারিয়ে দিলো অন্যতম ফেভারিট উরুগুয়ে। সুয়ারেজ প্রথম ম্যাচে হতাশ করলেন সুযোগ নষ্ট করে। আগের পর্বে লিখেছিলাম উরুগুয়ের ফুটবলের স্বর্ণযুগের কথা। পরবর্তীকালেও দিয়েগো ফোরলানের মত খেলোয়াড় এসেছেন উরুগুয়েতে। এবারেও তাদের ফুটবল দল বেশ ভালো। তবে ভারি দল আনা, আর তার সাথে মানানসই ফল করা এক নয়। এক ঝলকে উরুগুয়ের রেকর্ড দেখে নেওয়া যাক। ১৯৩০ আর ’৫০ এ চ্যাম্পিয়ান, তিনবার বাদে বাকি সমস্ত বিশ্বকাপেই দ্বিতীয় রাউন্ড কোয়ালিফাই করা ছাড়াও উরুগুয়ে দুবারের অলিম্পিকজয়ী এবং ১৫ বারের কোপা আমেরিকা জেতা দল। ফুটবল বলেই সেই ইতিহাস ময়দানের লড়াইতে কোনও কাজে আসেনি, সেদিনকার ফর্ম অনুযায়ী ফল হয়েছে। এবারের মিশর দল মোটেও হেলাফেলার নয়, সালাহ না খেলতে পারলেও তারা দ্বিতীয় পর্বে যেতে পারে, তুলনায় শ্লথ রাশিয়াকে হারাতে পারলে।
আর পড়ুন, FIFA World Cup 2018: বিশ্বকাপ ট্রিভিয়া-ইতিহাস থেকে
প্রতি বিশ্বকাপেই এমন কয়েকটি ম্যাচ থাকে যেগুলো ক্ষুদ্র দলগত সমর্থনের ঊর্ধ্বে উঠে বিশুদ্ধ ফুটবলানুরাগের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। পর্তুগাল-স্পেনের ম্যাচ এরকম একটি ম্যাচ হতে চলেছে, এরকম ইঙ্গিত ছিলো। ৩-৩ গোলের ড্র ম্যাচ সাক্ষী রয়ে গেল ক্রিসচিয়ানো রোনাল্ডোর একক প্রয়াসের। হ্যাটট্রিকের গোলটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই কারণে, যে স্পেন গোলকিপার দ্য হিয়া ও তাবড় ডিফেন্ডারদের (এর মধ্যে র্যামোস, পিকে ইত্যাদি প্রাক্তন বিশ্বজয়ী) প্রস্তুতির সমস্ত সুযোগ দিয়ে, এবং সবাইকে দাঁড় করিয়ে গোল করলেন রোনাল্ডো। সম্ভবত গ্রুপ লিগের সবথেকে কঠিন ম্যাচ খেলে নিল পর্তুগাল ও স্পেন। এর আগে ২০১০ সালে স্পেনের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিলো পর্তুগালকে। এখনও পর্যন্ত তৃতীয় স্থান (১৯৬৬) তাদের সেরা পারফর্মেন্স। স্পেনের বিশ্বকাপ গ্রাফ গত কয়েক বছর ধরেই তুঙ্গে, যদিও তাদের ফুটবলের ঐতিহ্য প্রাচীন এবং গৌরবময়। তিনবারের ইউরোপ সেরা (১৯৬৪, ২০০৮, ২০১২), ১৯৯২ সালের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ান স্পেন বিশ্বকাপে চারবারের কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট। ১৯৫০ এর বিশ্বকাপে চতুর্থ স্থান তাদের সেরা ফল ছিলো কিছুদিন আগে অবধি। ২০১০ এর বিশ্বকাপের পর সেটা পালটে গিয়ে হয়েছে “চ্যাম্পিয়ান”। ক্লাব ফুটবল ছাপিয়ে ইনিয়েস্তাদের নাম এখন অনেক বেশি ব্যাপ্ত। এবারেও তারা আশাজনকভাবেই ফিরে এলো দুবার পিছিয়ে গিয়েও। পরের সপ্তাহগুলোয় স্পেনের খেলা অবশ্যই দেখতে হবে।
মরোক্কো আর ইরানের খেলা ফুটবলের ছাত্রদের কাছে ক্লাসিক উদাহরণ কীভাবে সময়ে সুযোগ না নিলে তা আত্মঘাতী হয়। স্কিল ও গতিতে বেশ কিছুটা এগিয়ে ম্যাচের দখল নিলেও মরোক্কো প্রয়োজনীয় গোল পায়নি। একেবারে শেষ মুহূর্তের গোলে তিন পয়েন্ট পেলো ইরান। মরোক্কো ও ইরান দু দলের বিশ্বকাপ রেকর্ডই প্রায় একরকম। এবারের খেলার আগে ইরান বিশ্বকাপে একটি ম্যাচ জিতেছে, হেরেছে আটটি, ড্র করেছে তিনটিতে। মরোক্কো জিতেছে দুটি, হেরেছে সাতবার, ড্র করেছে চারটিতে। ইরান পরের রাউন্ডে গেলে অবাক হবো। মরোক্কো সম্ভাবনাময়, তবে কাজটা কঠিন হবে।
আরও পড়ুন, চা, রুটি বানানোর ফাঁকে হাল্কা ড্রিবলিং, সঞ্জীবও বলতে পারেন, রোনাল্ডোও
ফ্রান্সকে গত দুটো বিশ্বকাপেই ফেভারিট ধরা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে নিজেদের দেশেই কাপ জেতার পরে তো বটেই, তার আগে থেকেই অন্যতম প্রধান ফুটবলশক্তি হিসেবে ফরাসিদের গণ্য করা হয়। ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপে যে মুস্টিমেয় দল খেলেছিলো, তাদের মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। ২০০৬ সালের রানার্স আপ, ১৯৫৮ ও ১৯৮৬তে তৃতীয় স্থানাধিকারী ও ১৯৮২ তে চতুর্থ স্থানলাভ তথ্য হিসেবে ফ্রান্সের ফুটবল উৎকর্ষ যথেষ্ট ভালোভাবে প্রকাশ করেনা। তবে এই আলোচনায় স্ট্র্যাটেজির ইতিহাস আপাতত আনছিনা, যেহেতু আমাদের উদ্দেশ্য সদ্য হয়ে যাওয়া ম্যাচগুলোর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা। ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া কৌলীন্যে অনেক নিচে। তাদের বিশ্বকাপ অভিযান বহুদিন আগেই শুরু হয়েছে, যদিও এখনও উল্লেখযোগ্য কিছু তাদের ঝুলিতে নেই। এই বিশ্বকাপের আগে অবধি অস্ট্রেলিয়া জিতেছে মাত্র দুটি ম্যাচ, হেরেছে ৮ টি। সাম্প্রতিক অতীতে জার্মানী, স্পেন ইত্যাদি দেশের কাছে অস্ট্রেলিয়া বড়ো ব্যবধানে হেরেছে। কাজেই ২-১ গোলে ফ্রান্সের কাছে হার অস্ট্রেলিয়ার ভালো খেলারই ইঙ্গিতবহন করে।
পরের খেলা ছিলো পেরু ও ডেনমার্কের মধ্যে। মরোক্কো ও ইরানের খেলায় যেমন ভালো খেলেও হেরে গেলো মরোক্কো, তেমনি পেরুও দূর্দান্ত ফুটবল খেলেও হেরে গেলো। ডেনমার্কের মত পোড়খাওয়া দল বিশ্বকাপে কমই আছে। একে তো দীর্ঘদিনের আন্তর্জাতিক ফুটবল অভিজ্ঞতা (১৯৮৬ সাল থেকে টানা মূলপর্বে খেলে আসছে ড্যানিশরা, ১৯৯৮ তে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে), তাছাড়াও অসাধারণ ফিটনেস, সংঘবদ্ধ খেলার ধরণ, এবং নাছোড় মনোভাব তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে খুবই কঠিন করেছে। সেই দলকে পেরুর ফুটবলারেরা কোণঠাসা করে রাখলো প্রায় পুরো ম্যাচ।
আরও পড়ুন, FIFA World Cup 2018: বড় পর্দা, বড় হল, বড় লোন
এই পর্ব শুরু করেছিলাম যে ম্যাচ দিয়ে, শেষও করবো সেই আর্জেন্তিনা – আইসল্যান্ডের খেলা দিয়ে। শুধু মারাদোনা বা মেসির মত বিশাল তারকা নয়, আর্জেন্তিনার আসল শক্তি ব্রাজিল-উরুগুয়ের মতই অতি প্রাচীন এক ফুটবল যাপন। দুবারের চ্যাম্পিয়ন (১৯৭৮, ১৯৮৬)বা তিনবারের রানার্স আপ (১৯৩০, ১৯৯০, ২০১৪) হওয়া তাই হয়ত অপ্রাসঙ্গিক। অপ্রাসঙ্গিক হয়ত দুবারের অলিম্পিক জেতাও (২০০৪, ২০০৮), বা ১৪ বার কোপা আমেরিকা জেতার তথ্য। বিশ্বকাপের বিশ্বজনীন হওয়া, বা আরও একটু এগিয়ে বললে ফুটবলের বিশ্বজনীন হওয়ার জন্য যে কতিপয় দেশের ভূমিকা আছে তাদের মধ্যে আর্জেন্তিনা একটি। ছেঁড়া বুট আর বল নিয়েও, আধপেটা খেয়েও যে প্রথম বিশ্বের ইনফ্রাস্ট্রাকচারের বিরুদ্ধে লড়া যায়, এই বিশ্বাস লাতিন আমেরিকার ফুটবল ব্যতীত সম্ভব হতোনা। ফুটবল এগারোজনের খেলা। ভারত বীরপুজোর দেশ। খেলা দেখার সময় এই দুটো ব্যাপার খেয়াল রাখা উচিত। প্রিভিউতে অমুক বনাম তমুক, বা কোন একজন ফুটবলারের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কাঁটাছেঁড়াকে ফুটবলের বাইরের জিনিস বলে বুঝতে তাহলে সুবিধে হবে। আর প্রাক্তন খেলোয়াড়দের ম্যাচ বিশ্লেষণ পড়ার সময় অতি অবশ্যই হাতের কাছে নুনের পাত্র রাখুন, নইলে সবই “উটের পাকস্থলী” হয়ে যাবে। টিভির পর্দায় ক্লোজ আপ দেখে যাঁরা একজন ফুটবলারের মানসিক অবস্থা বুঝে ফেলেন, তাঁরা অপরাধদমনে প্রশাসনকে সাহায্য না করে বৃথাই প্রতিভার অপচয় করছেন।
এই লেখা শেষ করার ঠিক পরেই খেলা শেষ হয়েছে ব্রাজিল ম্যাচ। জার্মানী আর ব্রাজিলের অপ্রত্যাশিত হোঁচট এখন ঢুকে পড়বে আর্জেন্তিনার আটকে যাওয়ার সাথে একই সারিতে। সেইসব ম্যাচের ট্রিভিয়া নিয়ে ফিরে আসছি আগামী পর্বে।