দমদম নাগেরবাজারের অভীক হালদার। দীর্ঘ ১১ বছর রয়েছেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। আগে দুর্গাপুজো দেখতে ৩ ঘন্টা গাড়িতে যেতে হত ওই দেশের আরেক শহর জুরিখ। পুজোয় অংশগ্রহণ করে ফের প্রায় তিনশো কিলোমিটার গাড়িতে করে ফিরতে হত বাড়িতে। এবার আর জুরিখ নয়, জেনেভাতেই বাঙালিরা আয়োজন করে ফেলল প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপুজো। কলকাতা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে অভীক হালদার, সন্দীপন ঘোষ, অমিতাভ সরকাররা সপরিবারে আনন্দ-উল্লাসে একযোগে সামিল হলেন বাঙালির সর্বশ্রেষ্ট উৎসবে। দূরদেশ হলেও উৎসব মেতেছিল সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানায়। পুজোয় এসেছিলেন ফ্রান্স, জার্মীনাসহ অন্য দেশের মানুষজনও।
পুজো শুরুর এখানেও বিশেষ কাহিনী রয়েছে। প্রথমবারের দুর্গাপুজো শুরুর পিছনে রয়েছে দুই বন্ধুর উদ্যোগ। নাগেরবাজারের অভীক হালদার ও বেহালার সন্দীপন ঘোষ। জুলাই-অগস্টে দুর্গাপুজো করার ভাবনা শুরু। কলকাতায় এসে কুমোরটুলি যাওয়া। ৪ অগস্ট খোঁজখবর নেওয়া-কথাবার্তা শুরু। তারপর মৃৎশিল্পী মিন্টু পালের কাছে ১২ অগস্ট ফাইবারের দুর্গার বায়না। এবার কে আর আটকায়? ১৮ সেপ্টেম্বর সন্তানদের নিয়ে উড়ানে মাদুর্গা পৌঁছাল জুরিখ। তারপর ২১ সেপ্টেম্বর সপরিবারে সে দেশে ছাড়পত্র মিলল। দুর্গা প্রতিমার উচ্চতা ৭ ফুট। কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী সাড়ে ৫ ফুট। পুজোর মন্ডপে আড়াআড়ি ভাবে সেটিং ছিল ২০ফুট। ১ থেকে ৩ অক্টোবর ধুমধাম করে দুর্গাপুজোর আয়োজন চলল জেনেভায়।
বছর আটত্রিশের অভীক জেনেভায় বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে অভীক বলেন, 'আমি ও সন্দীপের পরিকল্পনা যে এত সহজে বাস্তবায়িত হবে তা প্রথমে ভাবতেই পারিনি। যখন কলকাতা থেকে জেনেভা ফিরে ওখানে সবাইকে দুর্গাপুজো আয়োজনের কথা বলি তখন প্রত্যেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আমাদের কাজটাও সহজ হয়ে যায়। আমরা কলকাতা থেকে ঢাক, মাটির প্রদীপ, দশকর্মা, পুজোর সামগ্রী নিয়ে এসেছি। পুরোহিত মৈনাক কাঞ্জিলাল এককথায় পুজো করতে রাজি হয়ে যান। তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী দেবযানী কাঞ্জিলাল ও তপোব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। মায়ের পুজো দিয়েই জেনেভার বাঙালীদের 'আগমনী' পথচলা শুরু করল। দীর্ঘ বছরের মনের ব্যথা এক লহমায় কেটেও গেল। ফিরে পেলাম দুর্গাপুজোয় বাঙালির আড্ডা।'
তবে এখানকার মতো ষষ্ঠী থেকে দশমী পাঁচ দিন পুজো প্রবাসে সর্বত্র হয় না। জেনেভায় আগমনীর এই পুজোতে ১ অক্টোবর দিনের প্রথম ধাপে হয়েছে ষষ্ঠী ও দ্বিতীয় ধাপে সপ্তমী। ২ অক্টোবর রবিবার সকালের দিকে ছিল অষ্টমী, বিকেলের দিকে নবমী। ৩ অক্টোবর দশমী। এদিন হবে সিঁদুর খেলা থেকে ধুনুচি নাচ। এখানে খাওয়া-দাওয়া চলেছে একেবারে বাঙালি মেজাজে। অভীক বলেন, 'একএক বেলায় একএক ধরনের মেনু। কখনও খিচুরি, ঝোড়ো আলুভাজা, গোবিন্দভোগের পায়েস, আবার রাতে অলু-ফুলকপির তরকারি, জিরে রাইস, রাবড়ি। রবিবার দুপুরে ছিল বাসন্তী পোলাউ, বেগুনি, ছানার ডালনা, রসমালাই, রাতেও ছিল খাবারের ব্যবস্থা।' মোদ্দা কথা পুজো উপলক্ষ্য়ে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জমিয়ে আড্ডা আর দেদার খাওয়া-দাওয়া বাঙালি মেজাজে জেনেভাতেই সেরে ফেললেন অভীক, অমিতাভরা। সেখানে ওড়িষার সম্বলপুরের কাছের রাঁধুনিও তাঁরা পেয়ে গিয়েছেন।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রধান দফতর। স্বাভাবিক ভাবে বিশ্বে জেনেভার বিশেষ পরিচিতিও আছে। অভীক জানিয়েছেন, সুইজারল্যান্ডে প্রায় ৮টি দুর্গাপুজো হয়। জেনেভাতে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো রয়েছে। তবে আগমনীর এই পুজো একমাত্র সার্বজনীন। আয়োজকরা জানিয়েছেন, এই পুজোতে শুধু প্রবাসী বাঙালি বা ভারতীয়রা আসেননি, এসেছেন স্থানীয়রা, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালিয়ান, চাইনিজরা। মোদ্দা কথা বিদেশে পরিবার নিয়ে থেকেও কলকাতার পুজোর বাঙালিয়ানা সংস্কৃতি বজায় রাখতে পেরে বেজায় খুশি জেনেভার আগমনীর সদস্যরা।