বিয়ের তিন দিন বাদে শ্বশুরঘর থেকে মেয়ে এসেছে বাপের বাড়ি। তাকে বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে জামাই গেছে কাজে। এদিকে বিকলে পেরিয়ে সন্ধে গড়িয়ে রাত গভীর। তাতেও জামাইয়ের দেখা নেই। সময়টা ১৯৪৬। ফেব্রুয়ারি মাস। শীতের রাত। রাস্তাঘাট শুনশান। বাড়ির সবাই খেয়েদেয়ে একে একে শুয়ে পড়েছে।
বাধ্য হয়ে শ্বশুরমশাই খুঁজতে বেরোলেন জামাইকে। আর কিছুক্ষণ পরে বাবাজীবনকে আবিষ্কার করলেন কাছেই রাধা ফিল্ম স্টুডিওয়। ছেঁড়া চিটচিটে একটা ত্রিপল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে। তার ফাঁকফোকর দিয়ে যতটুকু শরীর দেখা যায়, তাতে ভরতি ঝুল, কালি, ময়লা! এক মুহূর্ত আর সময় নষ্ট না করে গরগর করতে করতে বেরিয়ে এলেন তিনি! এই ছেলের সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন! সেই শ্বশুরের অমন বেআক্কেলে জামাইই পরে বাংলা সিনেমায়, থিয়েটারে জাঁকানো নাম, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়!
আরও পড়ুন, খিদিরপুরের মুন্সীগঞ্জ, এক চাঁদাতেই পুজো-মহরম
এ গল্প আমার শোনা ওঁরই সহধর্মিণী নীলিমা দেবীর কাছে। চারুচন্দ্র অ্যাভিনিউ-তে তাঁর স্বামীর তৈরি পুরোনো বাড়ির দোতলার চিলতে বসার ঘরে বসে। দু’বছর হল নীলিমা দেবী চলে গিয়েছেন। ‘সঙ্গীতশ্রী’ নামের লাল মেঝের, বড় উঠোন-দালানের সেকেলে সেই বাড়িটাও আজ আর নেই। বদলে ঝাঁ চকচকে হাল ফ্যাশনের কমপ্লেক্স। যার নাম হয়েছে ‘ভানুশ্রী’। তার দোতলায় থাকেন ভানু-নীলিমার জ্যেষ্ঠপুত্র, অকৃতদার সত্তরোর্ধ্ব গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়।
নীলিমা দেবী মানুষটিও কিন্তু কম কৃতী নন। ছোট থেকেই গানের চর্চা ছিল তাঁর। সঙ্গীতজ্ঞ সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রী। অন্য পরিচয়ে যিনি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাকা। নীলিমা দেবী অল ইন্ডিয়া রেডিওর গায়িকা ছিলেন। একটি ছবিতে সুরকার নির্মলেন্দু চৌধুরী সুর-টুর করে বেপাত্তা হয়ে যাওয়ায়, শেষে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে গান শেখানোর ভার পড়ে তাঁর ওপর।
আরও পড়ুন, রামকৃষ্ণ মিশনে মুখে ভাত! ছেলের প্রথম ছবি শেয়ার করলেন বিশ্বজিৎ-অন্তরা
তো সেই বিয়ের সময়ের গল্প বলতে বসে নীলিমা দেবী বলেছিলেন, "আমার বাপের বাড়ি ছিল একেবারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশের বাড়ি। 'রাধা ফিল্ম' কাছেই। যেখানে প্রথমদিকে দূরদর্শনের অফিস ছিল। ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও-ও তাই। যেটা এখন নবীনা সিনেমা। উনি তখন আয়রন অ্যান্ড স্টিল-এ চাকরি করেন। অফিস থেকে ফিরে আমায় পৌঁছে দিয়ে বললেন, 'রাধা-য় কাজ আছে। আসছি।' তারপর তো ওই কাণ্ড! রাধায় পৌঁছে বাবা ওঁকে তো দেখলেন, শুনলেন শুটিং চলছে, তখনও অনেক কাজ বাকি। এই শুনে বাড়ি ফিরে গুম মেরে বসে রইলেন। আমি আর কত জাগি! খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত দুটো, কী আড়াইটের সময় কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে উঠে দেখি, আমার মা তাঁর জামাইকে তোয়াজ করে খাওয়াচ্ছেন। সেই প্রথম ওঁর ছবি করতে যাওয়া।"
ছবির নাম ‘জাগরণ’। বিভূতি চক্রবর্তীর নির্দেশনা। ডেকেছিলেন উনিই। যেতেই বলেছিলেন, "দুর্ভিক্ষের সময়কার এক হাড়গিলে চিমসে মার্কা চেহারার লোক। তারই চরিত্রে অভিনয়। করো যদি বলো।" শোনামাত্র রাজি। তারপর তো যা হওয়ার হলো। এই যাঁর দ্বিরাগমনের আগে-পরের গপ্পো, এই যাঁর প্রথম ছবিতে অভিনয়ের নেপথ্য কাহিনি, তাঁর জীবন যে সোজা পথে চলার নয়, তা আর বলে দিতে লাগে! তা, বাঁকা তো আন্দাজ পেলেন, কিন্তু কতটা? টের পাওয়াটা বোধহয় অত সহজ কম্ম নয়। একেবারে গোড়া থেকেই নাহয় খানকতক গল্প বলা যাক।
আরও পড়ুন, বার্লিনের ‘ঘরোয়া’ পুজোর গরিমা আলাদা
তখন ভানু ঢাকায়। ইউনিভার্সিটির ছাত্র। বিএ পড়ছেন। অধ্যাপক বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তাঁকে ভালবাসার দলে আরও চার মহান মানুষ। ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার, কবি মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমুদ্দিন, কবি শহীদুল্লাহ। এঁদের প্রিয়পাত্রটি এমনই কাণ্ড বাঁধিয়ে বসলেন যে, পালিয়েই আসতে হল পদ্মাপার থেকে। তাও আবার কী করে? না, বন্ধু গোপাল মিঞার গাড়িতে, সিটের নীচে, পাটাতনে লুকিয়ে। ১৯৪১। এক ব্রিটিশ ইনফরমার খুন হলো। অনুশীলন সমিতি-র লোকজনদের হাতে। সেই দলের পাণ্ডা ছিলেন নাকি উনিই। তাতেই হুলিয়া জারি। তখন পালিয়ে আসা ছাড়া উপায় কী!
আরও পড়ুন, ঠাকুর দেখার সঙ্গে থাকুক নতুন ৫টি পুজোর গান
বিপ্লবীদের সঙ্গে ভানুর যোগাযোগটা কিন্তু এক-আধ দিনের নয়। সেই ইস্কুলবেলা থেকে। বয়স যখন আট-দশ। ‘গুরু’ মানতেন দীনেশ গুপ্তকে। তাঁরই সাইকেলে চেপে-চেপে ঘুরতেন। বুকের আড়ালে লুকোনো নিষিদ্ধ বইপত্তর। টিফিন বক্সে রিভলভার। সব বিপ্লবীদের পাচারের জন্য। পরে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহের সঙ্গেও ওঁর যোগাযোগ ছিল প্রবল। তিনি যখন জেলে, বাড়ি থেকে প্রায়ই তাঁর খাবার নিয়ে যেতেন ভানু। ছোট থেকেই এমন রোখা স্বভাব, ট্যারা-ট্যারা হাবভাব, কট্টরপন্থী রকমসকম।
কার থেকে পেয়েছিলেন এসব? রক্তে ছিল? বাবা জিতেন্দ্রনাথ ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেটের মোক্তার। মা সুনীতি দেবী, সরকারি শিক্ষা বিভাগের চাকুরে। সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া। এঁদের পুত্র সাম্যময়। ডাক নাম ভানু। ভানু-পুত্র গৌতমবাবু একবার বলছিলেন, "বাবার এই ডাকাবুকো স্বভাবটা বিশেষ করে ঠাকুমার কাছ থেকে পাওয়া।"
আরও পড়ুন, Gumnami movie review: নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য, কিছু বাস্তব, কিছু স্বপ্ন
কী রকম? "১৯০৫ সালের গল্প। ঠাকুমা ছিলেন বেঙ্গল বোর্ডের প্রথম ভারতীয় 'ইন্সপেক্ট্রেস অফ স্কুলস্’। যাচ্ছিলেন দার্জিলিং। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুল করে ইংরেজ লেডিদের কামরায় উঠে পড়েন। মেমেরা সাত তাড়াতাড়ি নেমে যেতে বললে, ঠাকুমা বলেন, 'পরের স্টেশনে নেমে যাব।' তাতে ওদের একজন কোনও কথাটথা না শুনে ঠাকুমার বাক্স-প্যাঁটরা সব দিল বাইরে ফেলে। তাতে ঠাকুমা সেই মেমকে এমন ঠ্যাঙানি দেন যে, সে তো অজ্ঞান। এবার গার্ড এসে ঠাকুমাকে হাজতে ঢোকাবে। ঠাকুমার এক ভাই ছিলেন জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি এসে তখন সামাল দেন। মারা যাওয়ার দু’দিন আগেও বাবা এ ঘটনা বলত।"
বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর যে এত প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন, তার সূত্রপাতও কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এরকমই একরোখা স্বভাবের কারণে। কলেজে হস্টেলের ছেলেরা সরস্বতী পুজোর নেমন্তন্ন করল। খুব ঘটা করে পুজো। এলাহী খাওয়াদাওয়া। তারই মাঝে কোনও এক বিকলাঙ্গ ভিখারী, যিনি আবার জাতিতে মুসলিম, কাঁদো-কাঁদো হয়ে দু’মুঠো খেতে চাইতে এলেন। তাঁকে খেদিয়ে যাচ্ছেতাই করে তাড়িয়ে দিল একদল ছাত্র। দূরে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করল কলেজ-ছাত্র সাম্যময়, ওরফে ভানু।
আরও পড়ুন, Mitin Mashi Review: ছবি মনোরঞ্জক কিন্তু গল্পের মিতিনের চেয়ে অনেকটাই আলাদা
ফূর্তি তুঙ্গে উঠল একটু পরেই। শুরু হল খাবারদাবার ছোড়াছুড়ি। এবার মাথায় রক্ত চড়ে গেল সাম্যময়ের। সোজা রান্নাঘরে ঢুকে টান মেরে মেরে খাবার ফেলে দিতে লাগলেন তিনি, "আমিও খামু না, কাউরে খাইতেও দিমু না।" বাধা দিতে এল ক’জন। তাদের ক’টাকে বেধড়ক পিটিয়ে হটালেন। ঘটনার জল বহুদূর গড়ালো। সবাই এককাট্টা সাম্যময়ের বিরুদ্ধে। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক সত্যেন বসু। সেই শুরু। ছাত্রের গলায় ঢাকাই কুট্টিদের নকশা শুনেও তিনি তারিফ করতেন। সে সময় বহু যাত্রা সম্মিলনী থেকে তাঁর ডাক আসত। তেমনই একবার নেমন্তন্ন করতে লোকজন এলেন। তাঁদের বলে দিলেন, "আরে, আমায় কেন, ভানুকে নিয়ে যাও।" তাঁরা তো নাছোড়। শেষে রসগোল্লা-টোল্লা খাইয়ে বিদেয় দিয়ে বললেন, "আমার কাছে গোল্লা পেলে, ভানুর কাছে গেলে রসটা পাবে।"
ভানুর এই ঢাকাই কুট্টিদের কমিক-এর ভক্ত ছিলেন আবার মুজতবা আলীও। সে অবশ্য অনেক পরের ঘটনা। সাহিত্যিক মনোজ বসুর বাড়িতে প্রথম দেখা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলীসাহেবের। ভানু ওঁকে বললেন, "আপনার সাহিত্যের আমি খুব ভক্ত।" উত্তরে তাঁকে চমকে দিয়ে মুজতবা আলী গড়গড়িয়ে 'ঢাকাই কুট্টি' বলতে থাকলেন! সে অবশ্য অন্য কথা।
আরও পড়ুন, ছোট ছবি ‘হলুদ বাড়ির চিঠি’, দেখুন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়
ফেরা যাক, জেদী, জেহাদী, একরোখা মানুষটির আরও গল্পে। কী ভালবাসতেন উত্তম কুমারকে! একেবারে ছোট ভাইয়ের মতো। উল্টোদিকে উত্তম কুমারও তাই। ডাকতেন 'ভানুদা তুই'। ওঁদের মধ্যে ভালো-ভালো গল্পের শেষ নেই। 'কাঞ্চনমূল্য' ছবি করতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে যাঁরা অর্থের জোগান দেন, উত্তম কুমার তাঁদের একজন। গৌতমবাবু আমায় বলেছিলেন, "ভ্রান্তিবিলাস ছবি করতে গিয়ে বাবাকে সোনার গিনি দিয়ে অ্যাডভান্স করেছিল উত্তমকাকু! উল্টোদিকে 'ছোটিসি মুলাকাত'-এর পর উত্তমকাকুর যখন হার্ট অ্যাটাক হলো, বাইরের কারও দেখা করা বারণ। বাবা ঠিক ম্যানেজ করে চলে গিয়েছিল। কেউ রুখতে পারেনি।"
আরও পড়ুন, ‘পাসওয়ার্ড’-এ নিরাপদ নয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নথি
সেই সম্পর্কে ছিটে লাগল ওই জেদী-নাছোড় মনটার জন্যই। সময়টা ষাটের শেষাশেষি। ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ ভেঙে ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি হলো। উত্তমকুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়রা চলে গেলেন ওদিকে। এদিকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রইলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমাররা। 'কালো তালিকা'য় নাম পড়ল ওঁদের। এই সময়ই ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ রিলিজ করবে। তাতেও বাধা দেওয়া হতে পারে খবর পেয়ে একজোট হলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার, অজিত লাহিড়ী, সৌমেন্দু রায়রা।
বিজলী সিনেমায় গণ্ডগোল হতে পারে শুনে ঠায় আট ঘণ্টা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতেন ওঁরা। এই সময়েই প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয় ওঁর। গৌতমবাবু বলছিলেন, "উত্তমকাকুর সঙ্গে বিচ্ছেদ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বাবা। পরে অবশ্য সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।"
আরও পড়ুন, পুজোয় হোমওয়ার্ক পেলেন ‘রানু পেল লটারি’-নায়ক
কত ঘটনা! কত ঘটনা! সুধীরলাল চক্রবর্তীর কথা বলি। প্রাণপ্রিয় শচীনকর্তা বম্বে চলে যাওয়ার পর সুধীরলালের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয় তাঁর। তখন সুধীরলালের খুব নাম। 'মধুর আমার মায়ের হাসি' মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। উনি থাকতেন লেক মার্কেটের কাছে। পাড়ার ছেলেরা একবার চড়াও হয় ওঁর ওপর। তাদের শায়েস্তা করতে সবচেয়ে আগে যে মানুষটি এগিয়ে যান, তিনি ভানু বন্দ্যেপাধ্যায়। দাদাগিরি, জুলুমবাজি, রোয়াব, কোনওদিন তোয়াক্কা করেন নি।
আরও পড়ুন, পুজোর রঙে মেতে উঠতে প্রস্তুত দেবলীনা-গৌরব, দেখুন ফোটো
১৯৫২-৫৩ সালের কথা। বামনেতা রাম চ্যাটার্জির তখন খুব দাপট। চন্দননগর থেকে তিনি তাঁর ভগ্নিপতি আর জনা চার-পাঁচ স্যাঙাত নিয়ে চড়াও হলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। কী ব্যাপার, না ফাংশনে যেতে হবে। বললেন, "পারব না। কাজ আছে।" উত্তর এল, "যদি জোর করে নিয়ে যাই, আটকাতে পারবে?" গাড়ি-বারান্দার কার্নিশে কয়েকটা মার্বেলের টব ছিল, সেগুলি দেখিয়ে উনি জবাব দিলেন, "তোমার মাথায় কী মাস্ল আছে, দেখি। ওগুলো মাথায় যদি মারি, কী করবে?"
আরও পড়ুন, অক্টোবর জমজমাট! বাংলা ও হিন্দি ৯টি ছবি, এক নজরে
তুলসী চক্রবর্তীর গল্পটা যেমন। হাতিবাগান পাড়া। গাড়ি নিয়ে স্টার-এ ‘পরিণীতা’র শো করতে যাচ্ছেন ভানু বন্দ্যেপাধ্যায়। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখলেন, একদল চ্যাংঙা ছোঁড়া তুলসী চক্রবর্তীর ধুতি, জামা ধরে টান মারছে। মাথায় চাঁটিও। সোজা গাড়ির দরজা খুলে নেমে গিয়ে এক-একটাকে চড়-থাপ্পড়, কিল, ঘুষি। মার খেয়ে নিমেষে পিছটান চ্যাংড়ার দল! অপমান দেখলে সইতেন না। অবজ্ঞা দেখলে রুখে দাঁড়াতেন। আপোস করার হাজার হাজার মাইল দূর দিয়ে হাঁটতেন। এমনও সময় গিয়েছে, হাতে কোনও কাজ নেই। একটু ঝুঁকলেই কিছু একটা জুটে যায়। কিন্তু মাথা নোয়াতে তিনি যে নারাজ!
যাত্রা দল করলেন। সে সব দিনের কথা বলেছিলেন নীলিমা দেবী, "যে মানুষ নরম বিছানা ছাড়া শুতেন না, তিনিই কিনা গ্রামেগঞ্জে গিয়ে শতরঞ্চি পেতে গাছের তলায় ঘুমোতেন। দিনের পর দিন ফুলুরি, মুড়ি, জিলিপি খেয়ে কাটিয়েছেন। একবার একটা আধভাঙা বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বুকের ওপর সিলিং-এর চাঙড় খসে পড়ল। তাতেও পরোয়া নেই।"
আরও পড়ুন, আমরা মা দুর্গার পুজো করি আর মেয়েদের বিক্রি করে দিই: সোনালি
এই এত কিছু সহ্য করার মাঝে যখন বম্বে যাওয়ার অফার আসত, ফিরিয়ে দিতেন। বারবার। কলকাতা তিনি ছাড়বেন না। কোনওক্রমে বন্ধু-পরিচালক সত্যেন বসুর 'বন্দিশ' বা দুলাল গুহর 'এক গাঁও কী কাহানি' করেছেন। বাকি সব ফিরিয়েছেন। কার না কার অফার ছেড়েছেন! গুরু দত্ত, বিমল রায়, শক্তি সামন্ত, প্রমোদ চক্রবর্তী...
ওদিকে ওঁর প্রতি আরব-পারে শ্রদ্ধা-প্রশংসার রকম শুনবেন? 'পাশের বাড়ি'র রিলিজের ১৬ বছর বাদে হিন্দি ভার্সন 'পড়োসন' হলো। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোলটা করলেন মেহমুদ। তখন বম্বেতে একটা ফাংশানে গিয়েছেন ভানু। শোনামাত্র রাহুল দেব বর্মণকে নিয়ে তাঁর হোটেলে চলে আসেন মেহমুদ। পরামর্শ নিতে। 'সাড়ে চুয়াত্তর' দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কেষ্ট মুখোপাধ্যায়। তার অনেক পরে 'সাগিনা মাহাতো'-র শুটিং, তখন বম্বেতে। দেখা হতে জাপটে ধরে তখনই বলেছিলেন, "দাদা, কী করেছেন ওফ্! ওটাই আপনার বেস্ট।" তবু তাঁকে নড়ানো যায় নি। হেলানো যায় নি। আপোসও না।
আরও পড়ুন, প্রেম কাহিনি, সম্পর্কের নয়া সমীকরণে ‘ঘরে বাইরে আজ’
জীবনকে কী চোখে দেখলে এমন সিধে থাকা যায়। নিজের ওপর কতটা বিশ্বাস থাকলে, এমন একবগ্গা লড়াই লড়া যায়। ভাবনার প্রতি কতটা সৎ হলে, এতটা সাহস দেখানো সম্ভব। সেই মানুষকে কেমন আজও 'রসিকতা' আর ‘কমিক’-এর বাক্সে বন্দী রাখল বাঙালি।
আরও পড়ুন, শোভাবাজার রাজবাড়ির জামাই পদ্মনাভ, শোনালেন ও বাড়ির পুজোর গল্প
একটা সময় 'সিরিয়াস রোল' করার জন্য ছটফট করতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছুতেই পেতেন না।এক্কেবারে শেষ দিকে এসে পেলেন 'অমৃতকুম্ভের সন্ধানে'। যাঁরা সে ছবি দেখেছেন, তাঁরাই বুঝেছেন, অন্য ধারায় কীভাবে নিজের জাত চিনিয়েছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
আড্ডায় বসে প্রায়ই একটা কথা বলতেন, "আমার দশা ক্যামন শোনেন। মা মারা গ্যাছে। শ্মশানে গেছি। চোখে জল। একটা লোক কাছে আইয়া কইল, 'আরে ভানুদা, কী হইসে?' কোনওক্রমে কইলাম, মা মারা গ্যাছে। শুইন্যা হাসতে হাসতে চইল্যা গ্যালো। যাইতে যাইতে কইল, ‘দ্যাখ, ভানুরে কাঁদলে কেমন লাগে!’ বুঝেন একবার, হালা, নিজে যখন শ্মশানে যামু, লোকে দেইখ্যা কইব, 'ওই দ্যাখ, ভানুর মাথাটা কেমন নড়তাসে'!"
আরও পড়ুন, যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন বোধহয় ভগবানই শক্তি দেন: পল্লবী
ঠাট্টা করতেন, ঠাট্টা। আর বলতেন, বারবার বলতেন, "ছিলাম বাঁড়ুজ্জে, হলাম ভাঁড়ুজ্জে। কী আর হইব!" কত কষ্ট যে চাপা ছিল এই ‘ঠাট্টা’র আড়ালে! বুঝিবা দমচাপা দলা দলা অনেক কান্না। কে তার খবর রাখল?
ছবি: সৌজন্যে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রতিচিত্রণ: প্রীতম পাল